গদ্যবিচিত্রা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গদ্যবিচিত্রা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
কুড়িগ্রামের সাহিত্য চর্চার খসড়া | শ্যামল ভৌমিক

কুড়িগ্রামের সাহিত্য চর্চার খসড়া | শ্যামল ভৌমিক

কুড়িগ্রামের সাহিত্য চর্চার খসড়া | শ্যামল ভৌমিক

 

সাহিত্য হচ্ছে সংস্কৃতি-কৃষ্টির ধারক বাহক। সেই অর্থে একটি দেশ জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি সাহিত্যের অবয়বে লালিত হয়, পরিষ্ফুটিত হয়, বিকশিত হয়। সাহিত্য ব্যতীত দেশ ও জাতির অস্তিত্ব শূন্য গর্ভের মতই।

তাই এর চর্চা ও লালনে সকলকেই এগিয়ে আসা উচিত। “সভ্যতা বিনির্মাণেও সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।”

সাহিত্যে যেমন আত্ম-উপলব্দির বিকাশ ঘটে, দেশ জাতির বাস্তব চিত্র ফুটে উঠে তেমনি তা নতুন প্রজন্মের নিকট এক অনুকরণীয় অধ্যায়রূপে বিবেচিত হয়।

সাহিত্য চর্চায় কুড়িগ্রাম জেলার বিশাল ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অনেক যুগান্তকারী লেখক কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক, নাট্যকার গোলাম সারোয়ার ও আব্দুল হাই সিকদার উচ্চ মর্যাদায় আসীন। তাঁরা  তিন’জনেই তাঁদের জন্মস্থানের ঠিকানা কুড়িগ্রাম বলে গর্ববোধ করেন। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক সম্প্রতি ইহলোক ত্যাগ করেও কুড়িগ্রামকে করে গেছেন সমৃদ্ধ।

রংপুর সদর এলাকা ও কুড়িগ্রাম এলাকার লোকদের মুখের ভাষা ও কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে কোন তফাৎ নেই। চর্যাপদের ভাষা ও নাথ সাহিত্যের ভাষা থেকেও এসত্য ইতিমধ্যে পন্ডিতগণ প্রমাণ করেছেন। পন্ডিতগণ এও দাবী করেছেন যে চর্যাপদের ভাষা বহুলাংশে রংপুর-কুড়িগ্রামের ভাষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ভাওয়াইয়া পল্লীগীতি বাংলা সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। ভাওয়াইয়া পল্লীগীতির কিংবদন্তী শিল্পী আব্বাস উদ্দিন কুড়িগ্রামের উত্তর প্রান্তের থানা শহর ভূরুঙ্গামারীর সীমান্তবর্তী তোরশা নদীর পাড়ের মানুষ। এক সময় কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী সড়ক ছিল তার বিচরণ পথ। কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাই ছিল তার গানের ভাষা। আব্বাস উদ্দিন কুড়িগ্রামের গৌরব ছিলেন। বৃহত্তর রংপুরেরও গৌরব, বাংলাদেশের গৌরব, বাঙালী জাতির গৌরব। ‘কুড়িগ্রাম জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে বিষয়টি সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।

সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’ ও ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকদ্বয় বাংলাদেশের সব জেলা শহরে ও ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন জেলাসহ কলকাতাতেও সাড়া জাগিয়েছে। এই নাটক দুটি সমকালীন শ্রেষ্ঠ নাটকের স্বীকৃতিধন্য হয়েছে, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় বাঙালীর গৌরবকে আরো একবার সমুন্নত করেছে। এ দুটি নাটকের ইংরেজি সংস্করণ বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। সৈয়দ হকের অন্যান্য কবিতার ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর নাটক ও কবিতা বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে রয়েছে। দেশবরেণ্য এ লেখকের অনেক কাব্যগ্রন্থ, গল্প, নাটক, উপন্যাস জনপ্রিয় হয়েছে পাঠকদের কাছে। তার লেখা সংগীত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ গৌরব সবার, এ গৌরব কুড়িগ্রামের, রংপুরের, বাংলাদেশের। এ গৌরব সকল সাহিত্য গবেষকদের।

ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক প্রয়াত তপন কুমার রুদ্রের কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতায় শ্রেনীঘাত’ ও ‘মাকে বলা আমার কিছু মিথ্যে কথা’  প্রবন্ধ 'প্রাক-পরিচয়' এবং উপন্যাস ‘অংশী’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তার অনেক কবিতা-প্রবন্ধ জাতীয় ও স্থানীয় পত্রপত্রিকার পাশাপাশি বিভিন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে যা জাতীয় মানের। মোস্তফা তোফায়েল হোসেন এর ‘কুড়িগ্রাম ও রংপুর জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থ প্রকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বাংলা ও ইংরেজি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও তার ইংরেজি-বাংলা দ্বিভাষীক কাব্য ঢাকা বই মেলায় ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে। কুড়িগ্রামের সাহিত্যকদের মধ্যে যার নাম বার বার ফিরে আসে তিনি প্রয়াত শিক্ষক আব্দুল হামিদ। যার অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক স্থানীয় সাহিত্যপত্রিকা সহ জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। যার মাধ্যমে অনেক সাহিত্যকর্মীর সৃষ্টি হয়েছে এই কুড়িগ্রামে। কুড়িগ্রামের একজন প্রবীণ আইনজীবি সরকার আব্দুল করিম শৈশব থেকেই এখন পর্যন্ত নিরবেই নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করে যাচ্ছেন। তার কোন বই প্রকাশিত না হলেও তার অসংখ্য কবিতা গল্প সাহিত্যপত্রিকা সহ স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে।

সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক একাধারে নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও উপন্যাসিক। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে ‘প্রাণহীন প্রতিকৃতি’, নির্বাচিত গল্প ও প্রবন্ধের বই ‘আত্মদার্শনিক প্রেক্ষিতে কবিতার অবস্থান’।

সাংবাদিক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনের প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘বাসন্তী কথা’, প্রবন্ধ ‘অপরাজনীতি ও অন্যান্য’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ ও নিবন্ধ জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা ও সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ হয়।

নূর উন নবী বাবুর লেখা মাঝে মাঝেই বিভিন্ন দৈনিক ও ম্যাগাজিনে দেখা যায়, তার প্রবন্ধের বই ‘বঙ্গবন্ধুর কর্মযজ্ঞ ও দ্বিতীয় বিপ্লব’ প্রকাশিত হয়েছে।

সাংবাদিক মমিনুল ইসলাম মঞ্জু শক্তিমান সাহিত্যকর্মী, তাঁর বেশকিছু প্রবন্ধ বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য সাময়িকীসহ স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকার প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতিভাবান লেখক, আলোচক, উপস্থাপক চঞ্চল বোসের প্রবন্ধ বিভিন্ন গবেষণা পত্রিকায় বেরিয়েছে।  এছাড়াও তার কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে।

কবি মিজান খন্দকারের কাব্যগ্রন্থ ‘যথাকবি নিরঞ্জন’, ‘জন্মান্তরিত হবো কোন নব গৃহে’, গল্প ‘পুনশ্চ যুদ্ধার্থীগণ’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তার অসংখ্য কবিতা প্রথম আলো, ভোরের কাগজ, জনকণ্ঠ সহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রায়ই দেখা যায়।

হেলাল জাহাঙ্গীর নাটক রচনা করে ইতিমধ্যেই নাট্যকার হিসেবে বেশ খ্যাতি পেয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য নাটক গুলো হচ্ছে ‘মহানন্দা’, ‘উত্তরে অগ্নিকাল’, ‘বিপ্লব বক্ষে স্বদেশ’। এছাড়াও তার দুটি কবিতার বই ‘আলোর উপরে আলো’, ‘জ্বলে প্রেম! জ্বলে আজন্ম বিপ্লব!!’ প্রকাশিত হয়েছে।


আব্রাহাম লিংকন এর কবিতার বই ‘শেষ যুদ্ধের ডাক দিয়ে যাই’, ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস’, ‘মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস রংপুর’ সহ বাংলা একাডেমির ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’ চতুর্থ খন্ডে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তার লেখা নিয়মিত জাতীয় দৈনিকে দেখা যায়।

কবি জ্যোতি আহমদ, ইমতে আহসান শিলু, সোলায়মান বাবুল, জামাল অন্তর, জুলকারনাইন স্বপন, মাইকেল রবিন সরকার, আশিষ বকসী, আলমগীর কবির, লাইলি বেগম প্রমুখ এর কবিতা নিয়মিত বিভিন্ন সংকলন ও ছোট কাগজে প্রকাশিত হয়েছে, এঁদের কবিতা বই আকারে প্রকাশ করার যোগ্যতাসম্পন্ন। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে এঁরা ইতিমধ্যে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে।

প্রয়াত লেখক হোসনে আরা পারুলের বেশ কিছু কবিতা উপন্যাস ও গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে।

সাংবাদিক আব্দুল খালেক ফারুক’র গল্পগ্রন্থ ‘কাঁটাতারে ঝুলে আছে ফেলানী’, নাটক ‘গোলামের দরবার’ ও উপন্যাস ‘সন্দেহভাজন’ প্রকাশিত হয়েছে।

জুলকারনাইন স্বপন এর গল্পগ্রস্থ ‘অতলে জীবন’, ইউসুফ আলমগীরে’র কবিতার বই ‘চক্করে চক্করে ওড়ে বাউরি বাতাস’, মাইকেল রবিন সরকার সম্পাদিত কবিতার বই ‘কিছু মেঘ ছায়ার শরীর’,  মাহফুজুর রহমান লিংকন’র কবিতার বই ‘অমীমাংসিত ফুলের দেবতা’, সজল সমুদ্রে’র কবিতার বই ‘পত্রে রচিত ভোর’ ও ‘ডালিম যেভাবে ফোঁটে’, মাহবুব অনিন্দ্য’র কবিতার বই ‘অপার কলিংবেল’, সাম্য রাইয়ান এর প্রবন্ধের বই ‘সুবিমল মিশ্র প্রসঙ্গে কতিপয় নোট', কবিতার বই ‘বিগত রাইফেলের প্রতি সমবেদনা’, ‘মার্কস যদি জানতেন’, রাশেদুন্নবী সবুজের কবিতার বই ‘অ্যা ড্যান্স নাইট জার্নাল’, উত্তম চৌধুরীর উপন্যাস ‘উমা অন্তর দহনে’, বাদশা সৈকত’র গল্পগ্রন্থ ‘জীবনের ছায়াপথ’, উপন্যাস ‘পলায়ন’, ‘তোমার জন্য লেখা’ কাব্য গ্রন্থ, ‘সর্ম্পকের দেয়াল’ সহ বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলার সহকারী অধ্যাপক সুশান্ত বর্মন প্রবন্ধ ও শিশুতোষ গল্প রচনায় যথেষ্ট পরিচিতি পেয়েছেন।

নবীনদের মধ্যে আতিকুর রহমান মিলু ‘শাব্দিক’ নামে একটি ছোট পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করছেন। এছাড়াও অাকরাম হোসেন, জাহানুর রহমান খোকন সহ বেশ কিছু নতুন ছেলে সাহিত্য চর্চায় অবদান রাখতে শুরু করেছে।

মনোরঞ্জন বর্মন উলিপুর থেকে একাধারে প্রাবন্ধিক, সমালোচক এবং ইতিহাস লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। কাফী বীর ও সাংবাদিক পরিমল মজুমদার শক্তিমান সাহিত্যকর্মী। ‘চিলমারীর ইতিহাস’  গ্রন্থের লেখক নাজমুল হুদা পারভেজ সম্ভাবনাময় লেখক। নাগেশ্বরীর কাদের, রেজাউল করিম রেজা, মেধাবী সাহিত্যের কর্মী। শ্বাশত ভট্টাচার্য গবেষক ও প্রাবন্ধিক। তিনি ‘রংপুর জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থে রংপুর জেলার ‘মেলা’ বিষয়ের প্রবন্ধকার, আলোচক। কুড়িগ্রামের সংস্কৃতি জগতের প্রায় অনুচ্চারিত দুটি নাম শামসুল ইসলাম মন্ডল ও দেবব্রত বকশী। প্রথমজন আলোচক, দ্বিতীয় জন বেতার ও মঞ্চ নাট্যকার, অভিনেতা ও গায়ক।

প্রিয় পাঠক এ লেখায় কুড়িগ্রামের সাহিত্যকর্মীদের সকল বিবরণ রয়েছে বলে আমি দাবী করি না।  তবে আগামীতে কুড়িগ্রামের সাহিত্য চর্চার ইতিবৃত্ত রচনা করতে লেখাটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করতেই পারি।

* শ্যামল ভৌমিক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী

সমকালীন কবিতা ও বোধের কিছু দিগন্ত | গোলাম কিবরিয়া পিনু

সমকালীন কবিতা ও বোধের কিছু দিগন্ত | গোলাম কিবরিয়া পিনু

সমকালীন কবিতা ও বোধের কিছু দিগন্ত | গোলাম কিবরিয়া পিনু

কবিতা লিখি, পড়ি ও কবিতা নিয়ে বিভিন্ন বিবেচনায় বিভিন্ন সময়ে অনুরণিত হতে থাকি। এ-ধরনের অবস্থাটা কাঙ্ক্ষিত বলেই জীবনের সাথে তা সাযুজ্যপূর্ণ ও স্পন্দনশীল হয়ে বনহরিণীর মতন চঞ্চলতা নিয়ে স্থির থাকতে দেয় না; এর ফলে কবিতা সম্পর্কে বিভিন্ন বোধ জেগে ওঠে। এইসব বোধ ধারাবাহিকতায় খুব বেশি ব্যবধানে বিচ্ছিন্ন থাকে না, দড়িছেঁড়া অবস্থায় নিয়ে যায় না; তবুও এই মুহূর্তে সমকালীন কবিতার অনুষঙ্গ নিয়ে আমার কিছু বিবেচনা অল্প-খানিক দিগন্ত উন্মোচন করবে মাত্র কিন্তু আরও দিগন্ত গুপ্ত-সুপ্ত থেকে যাবে।

শুধু অনুভবে নয়, বাস্তব পরিধিতে অস্থিরচিত্ততা এ-সমাজে বেড়েছে বেশ, নির্লজ্জ নীতিহীনতার প্রকোপ ছোঁয়াচে রোগের মত ছড়িয়ে পড়েছে; বেদনাদীর্ণ হওয়ার পরও চিকিৎসা নেই। বিবেকতাড়িত হয়ে নীতিহীনতার বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা যেন দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কবিরাও দিকভ্রান্তিতে পড়ে যায়-কত রকমের ধান্দা চারদিকে, এরমধ্যে কবির নিজস্ব বোধ নষ্ট হতে থাকে, কবি নিজেও পচাগন্ধ পায়-তখন কবিতা নিয়ে কবির এগিয়ে চলার সাহস-স্পর্ধা লুপ্ত হতে থাকে। এভাবে কবির পতনমুখী এক ধরনের অবস্থান তৈরি হয়ে যায়-সেই পরিস্থিতিতে কবিতা উন্মুখ হতে পারে না, কবিতার অপমৃত্যু ঘটে।

এই সময়ে-টিভির বিভিন্ন চ্যানেল-এর ছবি ও অনুষ্ঠানের মাদকতায় টেনে নিচ্ছে মানুষকে, নেশাগ্রস্ত করে তুলছে। আবার আধুনিক হয়ে ওঠার দৌড়ে কম্পিউটার-ইন্টারনেট ও বহুবিধ যোগাযোগ ব্যবস্থায় পর্ণো-মানসিকতাও সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে সংবাদপত্রও পাঠক টানার কৌশলে যৌনতা, রাজনীতি, খুনখারাপি ও বিভিন্ন স্টোরীর নামে ভেদবুদ্ধির চালচিত্র গিলানোর জন্য মেতে উঠেছে। এইসব কর্মকাণ্ডে রুচিতে এক ধরনের বাণিজ্যিক চাহিদা ও উপযোগিতা তৈরি হচ্ছে-যাতে কবিতার অবস্থান দূরবর্তী বদ্বীপের মত হয়ে পড়ছে অনেকটা।

বর্তমানে কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এর জন্য শুধু কবিরা দায়ী নয়। এ-জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অন্যান্য কারণও রয়েছে, তবুও সচেতনভাবে কবিদের জন্য এই সংকট কবিদেরই মোকাবেলা করতে হবে। তবে-এ ক্ষেত্রে কিছু কবি বিশেষভাবে দায়ী-তারা ভাবেন, তারাই একমাত্র কাব্যবোদ্ধা! যে ভাবেই কবিতা লিখেন না কেন, আর সেই কবিতায় কোনো শিল্পশর্ত পূরণ হোক না হোক বা ধারাবাহিক অভিজ্ঞতায় সামঞ্জস্য থাক বা না থাক কিংবা কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা না হোক-তবুও এভাবে কবিতাকে এক ধরনের শূন্যতায় নিক্ষেপ করতে তারা ভালোবাসেন। এদের ভূমিকায় আজ কবিতা ও পাঠকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে।

পাঠক হিসেবে লক্ষ্য করি-বর্তমানে কোনো কোনো কবি আধুনিকতার নামে ও পরিবর্তনের নামে কবিতাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে বিভ্রান্তিমূলক পর্যায়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট। কেনো কেনো কবি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বিপর্যয়েরও সৃষ্টি করছেন, এরফলে কবিতা হয়ে উঠছে কবিতার নামে খণ্ডিত এক পদ্ধতি মাত্র। শুধু বাঁক পরিবর্তনের ইচ্ছে নিয়ে চলার নাম এক ধরনের স্বাধীনতা হতে পারে কিন্তু আধুনিকতা মূর্ত নাও হতে পারে-কবিতায়। আধুনিকতা সমাজবিচ্ছিন্ন বিষয় নয় : সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়নির্দেশক দর্শন-চেতনা। শুধু পরিবর্তনের স্থূল চালচিত্র নিয়ে আধুনিকতা চিহিৃত হতে পারে না। কবিতা সমকালীন হলেই-তা আধুনিক হবে, তা ঠিক নয়। শুধু কবিতার আঙ্গিক পরিবর্তন হলেই-আধুনিক কবিতা হয়ে ওঠে না-এরসাথে চেতনাগত বিষয়টিও যুক্ত। সমাজের মানসিকতা পরিবর্তনের ফলে কবিতার পরিবর্তন হয়, তবে কবিরা-সমাজের অগ্রসর মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয় বলেই তারা পরিবর্তিত চেতনাকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায় টেনে নিয়ে মানুষের চেতনাকে সমৃদ্ধ করেন বা নতুনভাবে মানুষের ভাবনাজগতকে নির্মাণ করেন বা মানুষের বোধকে ভিন্ন দ্যূতিতে উজ্জ্বল করেন।

বাংলা কবিতা শুধু নয়, বিশ্বের অন্যান্য ভাষার কবিতাও ধারবাহিকতা নিয়ে উজ্জ্বল হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা প্রবহমানেরই নামান্তর। কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর পরিধি বেড়েছে, তবে তার মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক ও সাযুজ্য থেকেই যায়। মানুষের জীবনও চলছে চেতনার প্রবাহ নিয়ে, এই প্রবাহ বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন পরিধিতে ব্যাপ্তি লাভ করলেও-অনেক ধারণা  কাল পরিবর্তনের পরও একই থেকে যায়। কবিতার ক্ষেত্রেও এই ধরনের  অপরিবর্তনীয় বিষয় ও শিল্পশর্ত লক্ষণীয়। যদি বলি- চর্যাপদ থেকে বাংলা কবিতার যে বিকাশ, সেই বিকাশের ধারায় সমকালীন বাংলা কবিতার অস্তিত্ব ও উজ্জ্বলতা। আর এই কারণে বাংলা কবিতার যে সম্ভাবনা তা অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বাংলা কবিতার যে বৈশিষ্ট্য ও ব্যঞ্জনা রয়েছে, সেই প্রবহমান শক্তিকে ধারণ করেই সমকালীন বাংলা কবিতার সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করতে হবে।

বিভিন্ন ধরনের কবিতার অস্তিত্ব থেকে যায়। আর এই বিভিন্ন ধরনের কবিতা শুধু সাম্প্রতিকালেই লেখা হচ্ছে না, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্নকালে তা লেখা হয়েছে। এ কারণে কবিতাকে একক সংজ্ঞা দিয়ে চিহিৃত করা সম্ভব নয়। তাই বলে-কবিতাকে পিঠমোড়া করে নিয়ে নৈরাজ্যের হাটে বেচাকেনা করাও সমীচীন নয়। কবিতা বহুবিধ সংজ্ঞার মধ্যে থেকেও ধারাবাহিকতায় এক ধরনের অন্তঃপ্রাণ নিয়ে বাঁচে, বেঁচে থাকবে। কবিতা বহুবিধ শৈলীর সমন্বয়ে অভিজ্ঞতা-অনুভূতি-আবেগ নিয়ে প্রাণ পায়। আর সেজন্য কবি মাত্রই জানেন-ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর বহুবিধ অলংকারের তাৎপর্য। তবে যান্ত্রিকতার বাইরে কবি মস্তিষ্কের বহুবর্ণিল  অনুরণন প্রকৃত কবিতায় রূপ পেতে দেখি। যে কবিতা পাঠককে কাব্যরসে সিক্ত করে এক ভিন্ন শিল্পবোধে চঞ্চল করে তোলে, দোরখোলা মুক্ত দিগন্তে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত শুধু করে না, দর্শানুভূতিতে বিভিন্নমুখী তাৎপর্য সৃষ্টি করে, তখন তা প্রকৃত কবিতার উদাহরণ হয়ে ওঠে।

আশার কথা- সমকালীন কবিতায় ছন্দ শুধু গুরুত্ব পাচ্ছে না, মিলবিন্যাসের চমকপ্রদ ব্যবহারও আমরা লক্ষ্য করছি। ছন্দ ও মিলের যে এক ধরনের শক্তি রয়েছে- তা এখন শুধু প্রতীয়মান হচ্ছে না, পূর্বেও প্রতীয়মান হয়েছিল। বাংলা কবিতার (শুধু বাংলা কবিতা কেন, অন্য ভাষার কবিতায়ও লক্ষ্যণীয়) ধারাবাহিকতায় ছন্দের একটি শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। তাই বলবো- ছন্দের প্রত্যাবর্তন কবিতায় আসুক, আরও নিরীক্ষায় সংহত হোক। সত্তর-আশি বা পূর্বের কবিতায় ছন্দ যে একেবারে ছিল না, তা কিন্তু নয়। কবিতায় ছন্দ ব্যবহারে উদাসীনতা আমরা লক্ষ্য করেছি চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের কবিদের ক্ষেত্রে। সেই সময় থেকে বাংলা কবিতার বিভিন্ন পর্যায়ে ছন্দকে অগ্রাহ্য করে কবিতার অনেক মূল্যমানকেই নষ্ট করার মানসিকতা লক্ষ্য করা গেছে। পত্র-পত্রিকার প্রাচুর্য ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ছোট পত্রিকার আওতায় কাব্যচর্চার উন্নাসিক প্রবণতার ফলে কবিতা শুধু ছন্দের বিপরীতে দাঁড়ায়নি, বিভিন্ন অলংকারের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে, এর ফলে কবিতা শিথিল ও অনায়াস লেখনীর কসরৎ হয়ে দাঁড়ায়- এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। তবে বলবো না- ছন্দ ছাড়া কবিতা হয়নি বা হবে না কিংবা ছন্দেও ভাঙা-গড়া ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে না।

বিভিন্ন কবির কবিতায় বিভিন্ন বিষয় ও শৈলীর উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি। কবিতা স্পষ্ট-অস্পষ্ট, উচ্চকণ্ঠ-নিম্নকণ্ঠ, আখ্যানধর্মী-নাট্যধর্মী-লিরিকধর্মী ইত্যাদি রকমের হতেই পারে। পাঠকের সাথে কবির এক ধরনের যোগাযোগ স্থাপন করার উদ্দেশ্য থেকেই যায়- এই উদ্দেশ্য যে কোনো শিল্প মাধ্যমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে, সমকালীন কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্য হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যে কবিতা এককালে দুর্বোধ্য, তা পরবর্তিকালে বোধগম্য হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছে- রুচি, পাঠস্পৃহা ও অন্যান্য কারণে। কিন্তু বর্তমানে কিছু কিছু কবিতা লেখা হচ্ছে কবির বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে ও কবিতার সহজ প্রকাশ-সুযোগের জন্য; এমন কবিতা পাঠকের সাথে কাঙ্ক্ষিত সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না। এসব কবিতায় না আছে ভাবের সঙ্গতি, না আছে ছন্দের সঙ্গতি, না আছে অলংকারের সঙ্গতি, না আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গতি। এসব তথাকথিত কবিতার ফলে কবিতার পাঠক কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু পড়ছে না, কবিতা হয়ে উঠেছে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মধ্যে সবচেয়ে সহজলভ্য বস্তু। নিছক দুরূহতা ও অস্পষ্টতা নিয়ে কবিতাকে নৈরাজ্যের ভেতর ঠেলে দিয়ে কবিতার সম্ভাবনা ও মূল্যকে নষ্ট করা সমীচীন নয়। কবিতাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রূপকল্পে বিভিন্ন দ্যোতনা নিয়ে কবিতাকে উজ্জ্বল করার শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে কেউ কেউ বর্তমানে সৃজনমুখর, এমন কবিদের হাতেই সমকালীন কবিতার সম্ভাবনা বেশি।

কবিতা সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো শিল্পমাধ্যম নয়। তবে কবিকে সামাজিক দায় নিয়ে কবিতা লিখতে হলেও-তার সেই দায় পালনের সীমা কোন্ পর্যায়ে উপনীত হলে-কবিতার সৌন্দর্য নষ্ট হবে না-সেটা বুঝতে হবে। অন্যভাবে বলা যায় একটি কবিতা শিল্পশর্ত পূরণ করেই সামাজিক দায় বহনের শক্তি অর্জন করতে পারে। বাংলা কবিতার ধারায় কখনো কবিতা ধারণ করেছে বৌদ্ধ সাধনার বিষয়-যেমন চর্যাপদের দোহা, কখনো কৃষ্ণকথার শ্রীকৃষ্ণবিজয়, বৈষ্ণব পদাবলী, রামায়ণ-মহাভারত কিংবা বিংশ শতাব্দীর সময়ে মানুষের জীবন, সংগ্রাম, পরাধীনতা, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, নগরজীবনসহ সমাজের নানা পরিধির দিগন্ত। সমাজজীবন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কবিতায় রূপান্তর ঘটে। এই রূপান্তরের নব-নব সম্ভাবনাকে কবিতা ধারণ করে থাকে। কবির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে- কী দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি বর্তমানের  সমাজ ও সামাজিক জীবনকে দেখবেন, সমাজের কোন্ পরতে তার কাব্য-আলো ফেলবেন, কোন্ জিনিসটি বর্জন করবেন বা বিকশিত করবেন। কবিতা মানুষের জন্যই- ভালো কবিতার শিল্প-সৌন্দর্য স্বতঃস্ফুর্ত ও আনন্দময় অনুভূতির জন্ম দিয়ে থাকে।

পাঠক হিসেবে সমকালীন কবিতা নিয়মিত পড়ি, পড়তে গিয়ে অনেক কবিতা ভালো লাগে, মনোরাজ্যে স্পন্দন জাগায় ও দৃষ্টিভঙ্গিকে শাণিত করে, সৌন্দর্যের আলোয় আবার ভিন্ন মাত্রার তাৎপর্য সৃষ্টি করে। আবার অনেক কবিতা পড়ে মনে হয়- নৈরাশ্যের অন্ধকার নিয়ে এসব কবিতা বিপর্যস্ত। কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয়-তা নির্ণয় করার মাপকাঠি আমরা অনেক ক্ষেত্রে হারাতে বসেছি- গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা ও পারস্পরিক পৃষ্ঠ চুলকানোর কারণে। তবে এইভাবে বাজার গরম হলেও- সৎ পাঠক, সৎ সমালোচক, সৎ সম্পাদক প্রকৃত কবিতাকে ঠিকই চিহ্নিত করেন। যুগে যুগে এভাবেই চোরাস্রোত থেকে উদ্ধার পেয়ে প্রকৃত কবিতা বেঁচে থাকে কল্লোলিনীর জলধারায়।

ড. গোলাম কিবরিয়া পিনু : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
সূর্যসেনের দেশ থেকে মঙ্গলপাণ্ডের দেশে | জিললুর রহমান

সূর্যসেনের দেশ থেকে মঙ্গলপাণ্ডের দেশে | জিললুর রহমান

সূর্যসেনের দেশ থেকে মঙ্গলপাণ্ডের দেশে | জিললুর রহমান

২২ জানুয়ারী ২০১৮।

কোলকাতায় নেমেই ছুটলাম হাওড়া রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। হুড়াহুড়ি করে টিকেট কেটে বড় ঘড়ির নীচে দাঁড়াতে হবে। তড়িঘড়ি করে পৌঁছে দেখি কবি মৃদুল দাশগুপ্ত এসে দাঁড়িয়ে আছেন। বলেছিলাম, ট্রেনের ব্যাপারগুলো আমার জটিল লাগে। তাই শ্রীরামপুরে নিয়ে যাবার জন্যে সশরীরে এসে হাজির। চেপে বসলাম লোকাল ট্রেনে। মুড়িভাজা আর গজা চিবাতে চিবাতে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কথার শুরুতেই বললাম পশ্চিমবঙ্গের এই দিকটা আমার দেখা হয়নি। তখন দক্ষ ঐতিহাসিকের মত মৃদুলদা বলে গেলেন কিভাবে ডেনিস কলোনীর এই অঞ্চলটি ভারতীয় ফেডারেশনে যোগ দেয়। জানতে পেলাম ফরাসি অধ্যুষিত চন্দন নগরে গণভোটে ৯% লোক ফরাসি নিয়ন্ত্রণ থেকে ভারতীয় ফেডারেশনে সংযুক্ত হবার বিপক্ষে ভোট দিলে, তারা বংশপরম্পরায় ফরাসি নাগরিক সুবিধা ভোগ করছেন। তাদের মধ্যে একজন মৃদুলদা’র বন্ধুও আছেন। জানতে পেলাম, এখানকার ইন্দুবতী ভট্টাচার্য বুদ্ধদেব বসুর আগেই সরাসরি ফরাসি থেকে বোদলেয়র অনুবাদ করেছিলেন, যিনি পরে কংগ্রেসের সাংসদ হন। তিনি দেখতে ছিলেন অনেকটা ইন্দিরা গান্ধীর মতো। পরে জেনেছি এই ইন্দুমতী ভট্টাচার্য প্রকৃত-অর্থে  বিদুষী। উনি চন্দননগরের প্রবর্তক  নারীমন্দির নামে এক বিদ্যালয়ের  প্রধানশিক্ষিকা  ছিলেন। তিনি কেবল ফরাসি নয়, কিছুটা স্পেনিশও জানতেন।

আলাপ চলতে চলতে লিলুয়া, বালি, উত্তরপাড়া, রিষড়া পার হয়ে শ্রীরামপুর থামলাম। শ্রীরামপুর শহরের বুক চিরে রেললাইন দূরে ছুটে চলে যায়। রেললাইনের একপাশে গঙ্গার তীরে প্রাচীন শহর, যার পুরনো বাড়িঘর সব ডেনিস গথিকে তৈরি। কিছু ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে, কিছু সংস্কার করা হয়েছে, আবার কিছু ভবনের পলেস্তারা খসে ভেতরের ইট বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু নিশ্চিত বুঝা যায়, এসব বাড়িঘর বৃটিশ গথিকের নয়। রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটা ধরলাম গঙ্গার উল্টো দিকের পাড়ে গড়ে ওঠা নতুন শহরের দিকে। এদিকের বাড়িগুলো গত ৬০-৭০ বছরে উঠেছে। রেলস্টেশনের খুব কাছেই মৃদুলদা’র বাড়ি। বৌদি দরজা খুলে দিলেন, চায়ের আয়েজন করলেন। তারপর বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে।

প্রথমেই গেলাম প্রাচীনতম ডেনিস চার্চের সামনে। এই গির্জার প্রধান ফটক, তার কডিবরগা, এমনকি ঝুলন্ত বাতিও ডেনিশ। গির্জার সামনেই একটি ছোটমতন পার্ক। তাতে সাজিয়ে রাখা সাতটি কামান দেখিয়ে মৃদুলদা জানালেন কৈশোরে দেয়ালে বসে বসে তিনি দেখেছেন ডেনিস রাজকুমারী কামানগুলো রং করতে। সেই শিশু রাজকুমারী পরে ডেনমার্কের রাণী হয়েছিলেন। আরো জানা গেল, সিরাজউদ্দৌল্লা যখন ডেনিশদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, তখন এই ক’টা কামান নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে পারা যাবে না বুঝে ডেনিশরা সিরাজকে সাহায্য করেননি। সিরাজ এতে বেশ মনক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। এর পরে এগিয়ে গেলাম আদালতভবনের দিকে। পরিত্যক্ত আদালতভবনের স্তম্ভের দিকে তাকালেই তার বুনন যে বৃটিশ আদলে নয়, তা পরিষ্কার বুঝা যায়।

বলা হয়নি, ২২ জানুয়ারি ছিল স্বরস্বতী পূজা। এখানে এইদিনে ভ্যানেনটাইন দিবসের মতো তরুণ তরুণীরা ঘুরে বেড়ায়। মৃদুলদা’র বাড়িতে ঢুকার মুখেই একটি পূজামণ্ডপ দেখলাম। যে মেয়েটি মণ্ডপের রক্ষণাবক্ষণ করছে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জানলাম সে বাঙালি হয়ে যাওয়া অবাঙালি। আমার বিস্ময় দেখে, মৃদুলদা আবার খুলে ধরলেন ইতিহাসের ঝাঁপি। শ্রীরামপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার ওপারেই সিপাহীবিদ্রোহ খ্যাত ব্যারাকপুর। এখনো সেখানে সেনানিবাস আছে। সিপাহীবিদ্রোহের সময় অবাঙালি সৈনিকদের পরিবার পরিজন পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় এখানে। পরে বৃটিশ সরকার তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে যখন জুটমিল স্থাপন করে তাদের কর্মসংস্থান করে তারা এখানেই থেকে যায়। ১৫০ বছরের সময়বিবর্তনে তারা ধীরে মিশে যায় বাংলার আচার সংস্কৃতির সাথে। তারা বাংলায় ভাবে, বাংলায় কথা বলে, এমনকি বাংলার পূজাপার্বণে মেতে ওঠে উৎসবে। তাই যতই বেলা গড়াচ্ছে তরুণীরা সেজেগুজে বেরিয়ে আসছে তরুণদের সাথে স্বরস্বতী পূজার আনন্দমুখরতায়। তাই কোলকাতা শহরের কেন্দ্রে মাড়োয়ারিদের হিন্দি বাৎচিতে যারা মনে করেন বাংলা ভাষা এখানে বিপন্ন তাদের জানিয়ে রাখতে পারি — যেমন করে মৃদুলদাও বলেন যে, উন্নত সাহিত্য সংস্কৃতির বাংলা কখনো হিন্দির কাছে বিপন্ন হতে পারে না। বরং যেসব অবাঙালি আগে বা পরে বাংলায় আশ্রয় নিয়েছে, বিশেষত গ্রামান্চলে যারা থাকছে তারা বাঙালি।
গল্পটি যা বলার তা বলেছে - অনুবাদ: সুশান্ত বর্মন

গল্পটি যা বলার তা বলেছে - অনুবাদ: সুশান্ত বর্মন

গল্পটি যা বলার তা বলেছে - অনুবাদ: সুশান্ত বর্মন
জন্মেছিলেন ইরানে। ১৯১৯ সালের ২২ অক্টোবর। জিম্বাবুয়েতে পিতার খামারে কেটেছে সবুজ শৈশব। বিস্তীর্ণ প্রান্তর শিশু ডরিসকে নৈঃসঙ্গের সৌন্দর্য চিনিয়েছে। বিশাল দিগন্ত সম্প্রসারিত করেছে মনের জানালা। বাকী জীবনে ডরিস লেসিং এই ঔদার্য দিয়েই চিনেছেন পৃথিবীকে। প্রথম উপন্যাস ‘দ্যা গ্রাস ইজ সিঙ্গিং’ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে চারপাশে সাড়া পড়ে যায়। বর্ণবাদ এবং এ প্রেক্ষাপটে মানুষের মানবীয় সম্পর্কের টানাপোড়েন উপন্যাসের মূল বিষয়। ফলে ১৯৫৬ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ডরিস লেসিং নিষিদ্ধ হয়ে যান। একসময় কমিউনিজম তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং বাস্তব সমাজ তাঁকে হতাশ করে। তিনি আসলে তথাকথিত আদর্শনির্ভর জীবন যাপন করতে চাননি। ধর্মীয় চিন্তা, কমিউনিজম ইত্যাদি তাঁর কাছে ডগমা নির্ভরতা বলে মনে হয়। তিনি যে কোন রকমের ডগমার কাছে আত্মসমর্পণকে ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করেন। বস্তুত কোন কিছুর অবিনশ্বরতায় তাঁর বিশ্বাস নেই। যুদ্ধ তাকে সবসময় পীড়া দেয়। তিনি বলেন “প্রথম মহাযুদ্ধ আমাদেরকে মনুষ্যত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমাদের নীতিবোধকে ধ্বংস করেছে, আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। আমরা দিনে দিনে অমানবিক হয়ে যাচ্ছি।” ডরিস লেসিং এর লেখায় এর সবকিছুই এসেছে সমান্তরালভাবে। জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তাঁকে নারীবাদী হতে দেয়নি। বরং তিনি নারীবাদীদের নিয়ে সবসময় মশকরা করেছেন। তিনি বরং বলেন “আমাকে জড়িয়ে যেসব নারীবাদী বিশেষণ দেয়া হয় তার সবগুলোই মিথ্যা।” ডরিস লেসিং লিখতে বেশ পছন্দ করেন। নির্জনতা তাঁকে খুব টানে। পৃথিবীব্যাপী ঘুরে বেড়াবার একাধিক প্রস্তাব তিনি অবহেলায় ফিরিয়ে দেন। তিনি বলেন “ঘুরতে ভালো লাগেনা। তার চেয়ে এই সময়ে বাসায় বসে আর একটি বই লিখে ফেলি।” আটাশিতম জন্মদিনের মাত্র এগারোদিন আগে তাঁর নাম নোবেল পুরস্কার ২০০৭ এর জন্য ঘোষিত হয়। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। সেসময় তিনি অসুস্থ পুত্রকে হাসপাতালে দেখে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ির সামনে মিডিয়ার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে তিনি যখন ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেন তখনই টেলিফোনে নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়। আট মিনিটের এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন অ্যাডাম স্মিথ।

ড. লে: হ্যালো।
অ্যা. স্মি: শুভ সকাল। আমি কি ডরিস লেসিংয়ের সাথে কথা বলতে পারি?
ড. লে: কে বলছেন?
অ্যা. স্মি: নোবেল ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট থেকে আমি অ্যাডাম স্মিথ বলছি। সংরক্ষণে রাখার জন্য আমরা ঐতিহ্যগতভাবে নতুন লরিয়েটদের একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার টেলিফোনে নিয়ে থাকি। আশা করি এই আলোচনার জন্য খুব অল্প কয়েক মিনিট আমরা ব্যয় করবো।
ড. লে: আচ্ছা। তারপর?
অ্যা. স্মি: সত্যিই আপনাকে অনেক অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ।
ড. লে: ধন্যবাদ।
অ্যা. স্মি: সুইডিশ একাডেমীর প্রতিবেদনটি কি আপনি দেখার সময় পেয়েছেন?
ড. লে: না, আসলেই না। আমি এখনও দেখিনি। আপনি জানেন আমি এই দুপুরে আমার ছেলেকে হাসপাতালে রেখে এলাম। আমি ছাপানো কোন কিছু এখনও দেখিনি। আর…. নোবেল কমিটির সচিবের সাথে অবশ্য আমার আগে কথা হয়েছিল।
অ্যা. স্মি: তার মানে আপনি হোরেস ইঙ্গডাহল এর সাথে কথা বলেছেন?
ড. লে: হ্যাঁ।
অ্যা. স্মি: তাঁদের প্রতিবেদনে আপনার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, "আপনি নারী বিষয়ক অভিজ্ঞতার মহাকাব্যিক লেখক, যিনি সংশয়বাদ, জ্বালাময়ী শক্তি ও দূরদৃষ্টি দিয়ে বিভক্ত সভ্যতাকে নিরীক্ষার জন্য বিষয়ভূক্ত করেছেন।" আপনি কি মনে করেন এই বিশেষণগুলি আপনি যা লিখেছেন তার অন্তত: কাছাকাছি গিয়েছে?
ড. লে: আমি ঠিক জানিনা, যখন তারা এমন লিখেছে তখন তাদের মনে কি ছিল? কিন্তু দেখুন আমার মনে হয় তারা বিষয় বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বিপুল পরিমাণের লেখার মুখোমুখি হয়েছিল। আপনি কি মনে করেননা যে, এর সবগুলোকে মিলিয়ে সারাংশ করা বেশ কষ্টের?
অ্যা. স্মি: হ্যাঁ, তাতো বটেই।
ড. লে: এত সহজ নয়।
অ্যা. স্মি: তা ঠিক। ৫০টির বেশি বই এবং বহুমুখী বৈশিষ্ট্যের লেখার সংমিশ্রণ আপনার সম্পর্কে বর্ণনাকে কিছুটা অসাধ্য করে তোলে। হ্যাঁ তাই। আচ্ছা, যখন লেখেন তখন গল্পটি বলার চেয়ে কোন একটি উদ্দেশ্য আপনার মাথায় থাকে এমনটা কি আপনি মনে করেন?
ড. লে: অবশ্যই না। কারন মনে রাখবেন আমি একসময় কমুনিস্ট ছিলাম এবং মানুষের মনের কারিগর হিসেবে লেখকদের বেশ কিছু নোংরা উদাহরণ আমাদের আছে। আমাদের যে কাউকে ভীত করে তোলার জন্য এটা যথেষ্ট। আপনি জানেন আমি সেই প্রজন্মেরই একজন।
অ্যা. স্মি: তাহলে আপনার লেখায় উদ্দেশ্যমূলক কিছু খোঁজার ভার কি পাঠকদের উপরে দিতে চান?
ড. লে: আপনি জানেন পাঠকরা যে কোনভাবেই এটা করে। পাঠক তার নিজের মন নিজেই তৈরি করে নেয়। লেখক শুধু তাকে সঙ্গ দেয়। সেখানে আপনার করার কিছুই নেই। বস্তুত: আপনার লেখার ভুল ব্যাখ্যাও তারা করতে পারে। কিন্তু আপনি এমনটা বলতে পারেননা যে-”ওহ না! এধরণের বর্ণনা আদৌ ঠিক নয়। আমি যা বোঝাতে চেয়েছি তা অন্যকিছু।” আপনি লিখবেন এবং পাঠকরা যা চায় তা তাদের প্রত্যাশার উপরে ছেড়ে দিন।
অ্যা. স্মি: এবং এভাবে, তাদের জন্য…. অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি অগণিত পাঠককে আপনার লেখনীর কাছে নিয়ে আসতে উৎসাহিত করবে। যারা আপনার লেখা পড়েনি তাদেরকে শুরুর জায়গাটি বলবেন কি?
ড. লে: হয়তো অবাক হবেন তারপরও শুধুমাত্র তরুণরা পছন্দ করবে বলেই একটা বিষয় আপনাকে জানাই। এটা ’ফিফথ চাইল্ড’ সম্পর্কে। আমি বিস্মিত যে, অল্প বয়সীরা এটাকে পছন্দ করে। অতএব তারা এটা দিয়ে শুরু করতে পারে এবং নিজেদের কার্যকলাপ বুঝতে পারবে। আমি ‘মেরা ও ড্যান’ নামে একটি রহস্যগল্প লিখেছিলাম। যেটা তরুণদের পছন্দ বলে আমি জানি। এ সম্পর্কে…. এরপর আমার প্রথম উপন্যাস ‘দ্যা গ্রাস ইজ সিঙ্গিং’ এখনও কত জীবন্ত। তারা শুরু করার জন্য এটাকেও বেছে নিতে পারে।
অ্যা. স্মি: আপনার সৃজনশীলতা অবশ্যই বিস্ময়কর এবং আমার ধারণা কেউ কেউ অবাক হবে এটা ভেবে যে এত সাহিত্যকীর্তিকে আপনি কিভাবে সামলান। এটা কি এজন্যই যে আপনার মধ্যে অবিরাম কাজপাগলামোর একটি ঝোঁক রয়েছে? আপনার মনে অনেক গল্প বলার জন্য অপেক্ষা করছে? কোনটা এটাকে সচল রাখে?
ড. লে: আচ্ছা, এটা অবশ্যই সত্য যে, আমার একটা…, লেখালেখি বিষয়ে আমি নিজেই নিজেকে পরিচালিত করে। আপনি জানেন আমি এটা ছাড়া আর কিছু করিনা। আমি খুব একটা সামাজিক নই এবং আমি আমার পরিপার্শ্ব দ্বারা এমনভাবে বেষ্টিত যে আমাকে দিয়ে তারা লিখিয়ে নেয়। আপনি জানেন যদিও আমি সামাজিক ছিলামনা (আমি প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক মানুষ), কিন্তু তারপরও আমার ধারণা…. আমি যেটা ভাল পারি সেই আনন্দের জন্য জীবনকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করতে পারি।
অ্যা. স্মি: তাহলে এটা কি স্বআরোপিত নির্বাসন? অথবা এটা কি শুধুই সৃষ্টিশীলতা, যা অধিক সম্ভাবনাময় হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করে?
ড. লে: আসলে এটা সেটাই যা আমি নিজে করি। আমি প্রাকৃতিকভাবেই এটা করি। সবসময়, আমি সবসময় এখন কি লিখছি তা নিয়ে চিন্তা করি। কিন্তু আপনি জানেন আমার নানারকমের শখ নেই। এটাকেও সেরকম ভাবুন। একমাত্র বা অন্য কারণ হিসেবেও।
অ্যা. স্মি: গতকাল টেলিভিশনে আপনার প্রতিক্রিয়া দেখে যে কেউ প্রশ্নটির উত্তর আন্দাজ করতে পারবে। কিন্তু নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাব্যতার বিষয়ে কিছু বলুন।
ড. লে: ওহ সেটা ভাববেন না। আপনি জানেন, সাধারণত ২/১ মাসের মধ্যেই মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তারা সাক্ষাৎকারের জন্য চাতকের মতো অপেক্ষা করেনা। আর আমার অতো সময় নেই, আপনি জানেন এত কিছুর জন্য আমার অতো সময় নেই। তাই সমস্যাকে তার নিজেকেই সমাধান করতে হবে।
অ্যা. স্মি: আর একটি প্রশ্ন, আপনার রচনাশৈলীর পরিসীমা সম্পর্কে কিছু বলুন। সম্ভবত: কবিতা ছাড়া আপনি প্রায় সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এই যূথবদ্ধতা কি আপনি সচেতনভাবে বেছে নেননি? অথবা এটা নিজেকে প্রকাশ করার কিছু প্রয়োজনীয় ফর্ম মাত্র।
ড. লে: না, একসময় আমার এটা আইডিয়া, একটি গল্প অথবা কিছু একটা আমার মাথায় ছিল। তারপর এটা নিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে চাইল। আপনি জানেন, “ওহ, আমি একটি, জানিনা কি, একটি ৫০,০০০ শব্দের বাস্তববাদী বই লিখতে যাচ্ছি” - এরকমটা আমি কখনই বলবনা। তারপর যা ঘটল তা হল বইটি, গল্পটিতে আমি যা বলতে চেয়েছি তাই বর্ণনা করে। যেভাবে বলার ছিল সেভাবেই বলে। এজন্য বিভিন্ন ভঙ্গীতে আমাকে লিখতে হয়। যদি আপনি এভাবে তা বলতে চান তা পারেন, কারণ আমি সত্যি বিভিন্ন বিষয়ে গল্প লিখেছি। এটা অথবা সেটা পড়তে চাওয়ার প্রশ্ন এটা নয়। আমি মনে করি যখন আমি ‘সিকাস্তা’ ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করলাম, যেটা লক্ষ বছর পরিসীমার, এর ঘটনাগুলো নিজেই নিজেকে এক একটা ভঙ্গীতে উপস্থাপন করে। আপনি আসলে এভাবে শুরু করতে পারেননা, “ওহ, আচ্ছা, জো ব্লগ তার রান্নাঘরে বসেছিল এবং এক কাপ ‘টাইকু চা’ পান করল, এবং তার শ্যালিকাকে একটি চিঠি লিখল।” এটা ভিন্নভাবে বলার একটি পদ্ধতি আপনার থাকতে হবে। আসলে এটাই আমার বিষয়বৈচিত্র্যের মূল উৎস।
অ্যা. স্মি: হ্যাঁ, অপ্রচলিত পদ্ধতিকে আপনি আত্মস্থ করতে পেরেছেন এটা বুঝতে সুইডিশ একাডেমী অনেক লম্বা সময় নিয়ে ফেলেছে।
ড. লে: এ বিষয়ে আমার ধারণা, সম্ভবত, বিজ্ঞান কল্পকাহিনীকে নোবেল কমিটির লোকজন অতটা পছন্দ করেনা। এর মানে, আমার ধারণা তারা এর খুবই ভুল ব্যাখ্যা করেছে। হয়তো এখন তারা এটা সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছে। যেমন উদাহরণস্বরূপ ‘মেমোরীজ অব এ সারভাইভার’, অথবা ‘ব্রিফিং ফর এ ডিসেন্ট ইনটু হেল’। এগুলো শ্রেণীবদ্ধ করা বেশ কঠিন। হয়তো এটা তাদের জন্যও কঠিন ছিল।
অ্যা. স্মি: আচ্ছা, মনে হচ্ছে নোবেল কমিটির পছন্দ অনেককে আনন্দিত করেছে। গতকাল হোরেস ইঙ্গডাহল যখন আপনার নাম ঘোষণা করছিলেন তখন অসংখ্য প্রশংসা ঝরে পড়ছিল।
ড. লে: ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।
অ্যা. স্মি: আমাদের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এই ডিসেম্বরে যখন আপনি পুরস্কার নেয়ার জন্য স্টকহোমে আসবেন আমার ধারণা হোরেস ইঙ্গডাহল আপনার একটি লম্বা সাক্ষাৎকার নেবেন। ততোদিন পর্যন্ত আপনার অপেক্ষায় রইলাম।
ড. লে: আপনার দেখা পাবো আশা রাখি। ধন্যবাদ।
অ্যা. স্মি: আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ড. লে: বাই
অ্যা. স্মি: বাই বাই।