সমকালীন কবিতা ও বোধের কিছু দিগন্ত | গোলাম কিবরিয়া পিনু

সমকালীন কবিতা ও বোধের কিছু দিগন্ত | গোলাম কিবরিয়া পিনু

কবিতা লিখি, পড়ি ও কবিতা নিয়ে বিভিন্ন বিবেচনায় বিভিন্ন সময়ে অনুরণিত হতে থাকি। এ-ধরনের অবস্থাটা কাঙ্ক্ষিত বলেই জীবনের সাথে তা সাযুজ্যপূর্ণ ও স্পন্দনশীল হয়ে বনহরিণীর মতন চঞ্চলতা নিয়ে স্থির থাকতে দেয় না; এর ফলে কবিতা সম্পর্কে বিভিন্ন বোধ জেগে ওঠে। এইসব বোধ ধারাবাহিকতায় খুব বেশি ব্যবধানে বিচ্ছিন্ন থাকে না, দড়িছেঁড়া অবস্থায় নিয়ে যায় না; তবুও এই মুহূর্তে সমকালীন কবিতার অনুষঙ্গ নিয়ে আমার কিছু বিবেচনা অল্প-খানিক দিগন্ত উন্মোচন করবে মাত্র কিন্তু আরও দিগন্ত গুপ্ত-সুপ্ত থেকে যাবে।

শুধু অনুভবে নয়, বাস্তব পরিধিতে অস্থিরচিত্ততা এ-সমাজে বেড়েছে বেশ, নির্লজ্জ নীতিহীনতার প্রকোপ ছোঁয়াচে রোগের মত ছড়িয়ে পড়েছে; বেদনাদীর্ণ হওয়ার পরও চিকিৎসা নেই। বিবেকতাড়িত হয়ে নীতিহীনতার বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা যেন দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কবিরাও দিকভ্রান্তিতে পড়ে যায়-কত রকমের ধান্দা চারদিকে, এরমধ্যে কবির নিজস্ব বোধ নষ্ট হতে থাকে, কবি নিজেও পচাগন্ধ পায়-তখন কবিতা নিয়ে কবির এগিয়ে চলার সাহস-স্পর্ধা লুপ্ত হতে থাকে। এভাবে কবির পতনমুখী এক ধরনের অবস্থান তৈরি হয়ে যায়-সেই পরিস্থিতিতে কবিতা উন্মুখ হতে পারে না, কবিতার অপমৃত্যু ঘটে।

এই সময়ে-টিভির বিভিন্ন চ্যানেল-এর ছবি ও অনুষ্ঠানের মাদকতায় টেনে নিচ্ছে মানুষকে, নেশাগ্রস্ত করে তুলছে। আবার আধুনিক হয়ে ওঠার দৌড়ে কম্পিউটার-ইন্টারনেট ও বহুবিধ যোগাযোগ ব্যবস্থায় পর্ণো-মানসিকতাও সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে সংবাদপত্রও পাঠক টানার কৌশলে যৌনতা, রাজনীতি, খুনখারাপি ও বিভিন্ন স্টোরীর নামে ভেদবুদ্ধির চালচিত্র গিলানোর জন্য মেতে উঠেছে। এইসব কর্মকাণ্ডে রুচিতে এক ধরনের বাণিজ্যিক চাহিদা ও উপযোগিতা তৈরি হচ্ছে-যাতে কবিতার অবস্থান দূরবর্তী বদ্বীপের মত হয়ে পড়ছে অনেকটা।

বর্তমানে কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এর জন্য শুধু কবিরা দায়ী নয়। এ-জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অন্যান্য কারণও রয়েছে, তবুও সচেতনভাবে কবিদের জন্য এই সংকট কবিদেরই মোকাবেলা করতে হবে। তবে-এ ক্ষেত্রে কিছু কবি বিশেষভাবে দায়ী-তারা ভাবেন, তারাই একমাত্র কাব্যবোদ্ধা! যে ভাবেই কবিতা লিখেন না কেন, আর সেই কবিতায় কোনো শিল্পশর্ত পূরণ হোক না হোক বা ধারাবাহিক অভিজ্ঞতায় সামঞ্জস্য থাক বা না থাক কিংবা কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা না হোক-তবুও এভাবে কবিতাকে এক ধরনের শূন্যতায় নিক্ষেপ করতে তারা ভালোবাসেন। এদের ভূমিকায় আজ কবিতা ও পাঠকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে।

পাঠক হিসেবে লক্ষ্য করি-বর্তমানে কোনো কোনো কবি আধুনিকতার নামে ও পরিবর্তনের নামে কবিতাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে বিভ্রান্তিমূলক পর্যায়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট। কেনো কেনো কবি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বিপর্যয়েরও সৃষ্টি করছেন, এরফলে কবিতা হয়ে উঠছে কবিতার নামে খণ্ডিত এক পদ্ধতি মাত্র। শুধু বাঁক পরিবর্তনের ইচ্ছে নিয়ে চলার নাম এক ধরনের স্বাধীনতা হতে পারে কিন্তু আধুনিকতা মূর্ত নাও হতে পারে-কবিতায়। আধুনিকতা সমাজবিচ্ছিন্ন বিষয় নয় : সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়নির্দেশক দর্শন-চেতনা। শুধু পরিবর্তনের স্থূল চালচিত্র নিয়ে আধুনিকতা চিহিৃত হতে পারে না। কবিতা সমকালীন হলেই-তা আধুনিক হবে, তা ঠিক নয়। শুধু কবিতার আঙ্গিক পরিবর্তন হলেই-আধুনিক কবিতা হয়ে ওঠে না-এরসাথে চেতনাগত বিষয়টিও যুক্ত। সমাজের মানসিকতা পরিবর্তনের ফলে কবিতার পরিবর্তন হয়, তবে কবিরা-সমাজের অগ্রসর মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয় বলেই তারা পরিবর্তিত চেতনাকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায় টেনে নিয়ে মানুষের চেতনাকে সমৃদ্ধ করেন বা নতুনভাবে মানুষের ভাবনাজগতকে নির্মাণ করেন বা মানুষের বোধকে ভিন্ন দ্যূতিতে উজ্জ্বল করেন।

বাংলা কবিতা শুধু নয়, বিশ্বের অন্যান্য ভাষার কবিতাও ধারবাহিকতা নিয়ে উজ্জ্বল হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা প্রবহমানেরই নামান্তর। কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর পরিধি বেড়েছে, তবে তার মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক ও সাযুজ্য থেকেই যায়। মানুষের জীবনও চলছে চেতনার প্রবাহ নিয়ে, এই প্রবাহ বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন পরিধিতে ব্যাপ্তি লাভ করলেও-অনেক ধারণা  কাল পরিবর্তনের পরও একই থেকে যায়। কবিতার ক্ষেত্রেও এই ধরনের  অপরিবর্তনীয় বিষয় ও শিল্পশর্ত লক্ষণীয়। যদি বলি- চর্যাপদ থেকে বাংলা কবিতার যে বিকাশ, সেই বিকাশের ধারায় সমকালীন বাংলা কবিতার অস্তিত্ব ও উজ্জ্বলতা। আর এই কারণে বাংলা কবিতার যে সম্ভাবনা তা অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বাংলা কবিতার যে বৈশিষ্ট্য ও ব্যঞ্জনা রয়েছে, সেই প্রবহমান শক্তিকে ধারণ করেই সমকালীন বাংলা কবিতার সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করতে হবে।

বিভিন্ন ধরনের কবিতার অস্তিত্ব থেকে যায়। আর এই বিভিন্ন ধরনের কবিতা শুধু সাম্প্রতিকালেই লেখা হচ্ছে না, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্নকালে তা লেখা হয়েছে। এ কারণে কবিতাকে একক সংজ্ঞা দিয়ে চিহিৃত করা সম্ভব নয়। তাই বলে-কবিতাকে পিঠমোড়া করে নিয়ে নৈরাজ্যের হাটে বেচাকেনা করাও সমীচীন নয়। কবিতা বহুবিধ সংজ্ঞার মধ্যে থেকেও ধারাবাহিকতায় এক ধরনের অন্তঃপ্রাণ নিয়ে বাঁচে, বেঁচে থাকবে। কবিতা বহুবিধ শৈলীর সমন্বয়ে অভিজ্ঞতা-অনুভূতি-আবেগ নিয়ে প্রাণ পায়। আর সেজন্য কবি মাত্রই জানেন-ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর বহুবিধ অলংকারের তাৎপর্য। তবে যান্ত্রিকতার বাইরে কবি মস্তিষ্কের বহুবর্ণিল  অনুরণন প্রকৃত কবিতায় রূপ পেতে দেখি। যে কবিতা পাঠককে কাব্যরসে সিক্ত করে এক ভিন্ন শিল্পবোধে চঞ্চল করে তোলে, দোরখোলা মুক্ত দিগন্তে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত শুধু করে না, দর্শানুভূতিতে বিভিন্নমুখী তাৎপর্য সৃষ্টি করে, তখন তা প্রকৃত কবিতার উদাহরণ হয়ে ওঠে।

আশার কথা- সমকালীন কবিতায় ছন্দ শুধু গুরুত্ব পাচ্ছে না, মিলবিন্যাসের চমকপ্রদ ব্যবহারও আমরা লক্ষ্য করছি। ছন্দ ও মিলের যে এক ধরনের শক্তি রয়েছে- তা এখন শুধু প্রতীয়মান হচ্ছে না, পূর্বেও প্রতীয়মান হয়েছিল। বাংলা কবিতার (শুধু বাংলা কবিতা কেন, অন্য ভাষার কবিতায়ও লক্ষ্যণীয়) ধারাবাহিকতায় ছন্দের একটি শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। তাই বলবো- ছন্দের প্রত্যাবর্তন কবিতায় আসুক, আরও নিরীক্ষায় সংহত হোক। সত্তর-আশি বা পূর্বের কবিতায় ছন্দ যে একেবারে ছিল না, তা কিন্তু নয়। কবিতায় ছন্দ ব্যবহারে উদাসীনতা আমরা লক্ষ্য করেছি চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের কবিদের ক্ষেত্রে। সেই সময় থেকে বাংলা কবিতার বিভিন্ন পর্যায়ে ছন্দকে অগ্রাহ্য করে কবিতার অনেক মূল্যমানকেই নষ্ট করার মানসিকতা লক্ষ্য করা গেছে। পত্র-পত্রিকার প্রাচুর্য ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ছোট পত্রিকার আওতায় কাব্যচর্চার উন্নাসিক প্রবণতার ফলে কবিতা শুধু ছন্দের বিপরীতে দাঁড়ায়নি, বিভিন্ন অলংকারের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে, এর ফলে কবিতা শিথিল ও অনায়াস লেখনীর কসরৎ হয়ে দাঁড়ায়- এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। তবে বলবো না- ছন্দ ছাড়া কবিতা হয়নি বা হবে না কিংবা ছন্দেও ভাঙা-গড়া ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে না।

বিভিন্ন কবির কবিতায় বিভিন্ন বিষয় ও শৈলীর উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি। কবিতা স্পষ্ট-অস্পষ্ট, উচ্চকণ্ঠ-নিম্নকণ্ঠ, আখ্যানধর্মী-নাট্যধর্মী-লিরিকধর্মী ইত্যাদি রকমের হতেই পারে। পাঠকের সাথে কবির এক ধরনের যোগাযোগ স্থাপন করার উদ্দেশ্য থেকেই যায়- এই উদ্দেশ্য যে কোনো শিল্প মাধ্যমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে, সমকালীন কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্য হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যে কবিতা এককালে দুর্বোধ্য, তা পরবর্তিকালে বোধগম্য হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছে- রুচি, পাঠস্পৃহা ও অন্যান্য কারণে। কিন্তু বর্তমানে কিছু কিছু কবিতা লেখা হচ্ছে কবির বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে ও কবিতার সহজ প্রকাশ-সুযোগের জন্য; এমন কবিতা পাঠকের সাথে কাঙ্ক্ষিত সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না। এসব কবিতায় না আছে ভাবের সঙ্গতি, না আছে ছন্দের সঙ্গতি, না আছে অলংকারের সঙ্গতি, না আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গতি। এসব তথাকথিত কবিতার ফলে কবিতার পাঠক কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু পড়ছে না, কবিতা হয়ে উঠেছে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মধ্যে সবচেয়ে সহজলভ্য বস্তু। নিছক দুরূহতা ও অস্পষ্টতা নিয়ে কবিতাকে নৈরাজ্যের ভেতর ঠেলে দিয়ে কবিতার সম্ভাবনা ও মূল্যকে নষ্ট করা সমীচীন নয়। কবিতাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রূপকল্পে বিভিন্ন দ্যোতনা নিয়ে কবিতাকে উজ্জ্বল করার শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে কেউ কেউ বর্তমানে সৃজনমুখর, এমন কবিদের হাতেই সমকালীন কবিতার সম্ভাবনা বেশি।

কবিতা সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো শিল্পমাধ্যম নয়। তবে কবিকে সামাজিক দায় নিয়ে কবিতা লিখতে হলেও-তার সেই দায় পালনের সীমা কোন্ পর্যায়ে উপনীত হলে-কবিতার সৌন্দর্য নষ্ট হবে না-সেটা বুঝতে হবে। অন্যভাবে বলা যায় একটি কবিতা শিল্পশর্ত পূরণ করেই সামাজিক দায় বহনের শক্তি অর্জন করতে পারে। বাংলা কবিতার ধারায় কখনো কবিতা ধারণ করেছে বৌদ্ধ সাধনার বিষয়-যেমন চর্যাপদের দোহা, কখনো কৃষ্ণকথার শ্রীকৃষ্ণবিজয়, বৈষ্ণব পদাবলী, রামায়ণ-মহাভারত কিংবা বিংশ শতাব্দীর সময়ে মানুষের জীবন, সংগ্রাম, পরাধীনতা, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, নগরজীবনসহ সমাজের নানা পরিধির দিগন্ত। সমাজজীবন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কবিতায় রূপান্তর ঘটে। এই রূপান্তরের নব-নব সম্ভাবনাকে কবিতা ধারণ করে থাকে। কবির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে- কী দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি বর্তমানের  সমাজ ও সামাজিক জীবনকে দেখবেন, সমাজের কোন্ পরতে তার কাব্য-আলো ফেলবেন, কোন্ জিনিসটি বর্জন করবেন বা বিকশিত করবেন। কবিতা মানুষের জন্যই- ভালো কবিতার শিল্প-সৌন্দর্য স্বতঃস্ফুর্ত ও আনন্দময় অনুভূতির জন্ম দিয়ে থাকে।

পাঠক হিসেবে সমকালীন কবিতা নিয়মিত পড়ি, পড়তে গিয়ে অনেক কবিতা ভালো লাগে, মনোরাজ্যে স্পন্দন জাগায় ও দৃষ্টিভঙ্গিকে শাণিত করে, সৌন্দর্যের আলোয় আবার ভিন্ন মাত্রার তাৎপর্য সৃষ্টি করে। আবার অনেক কবিতা পড়ে মনে হয়- নৈরাশ্যের অন্ধকার নিয়ে এসব কবিতা বিপর্যস্ত। কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয়-তা নির্ণয় করার মাপকাঠি আমরা অনেক ক্ষেত্রে হারাতে বসেছি- গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা ও পারস্পরিক পৃষ্ঠ চুলকানোর কারণে। তবে এইভাবে বাজার গরম হলেও- সৎ পাঠক, সৎ সমালোচক, সৎ সম্পাদক প্রকৃত কবিতাকে ঠিকই চিহ্নিত করেন। যুগে যুগে এভাবেই চোরাস্রোত থেকে উদ্ধার পেয়ে প্রকৃত কবিতা বেঁচে থাকে কল্লোলিনীর জলধারায়।

ড. গোলাম কিবরিয়া পিনু : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

0 comments: