গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অভিযোগহীন একজন | বাদশাহ্ সৈকত

অভিযোগহীন একজন | বাদশাহ্ সৈকত

অভিযোগহীন একজন | বাদশাহ্ সৈকত
মনের সকল অভিযোগ দুরে ঠেলে একজন নিখাঁদ অভিযোগহীন মানুষ হওয়ার চেষ্টায় নিজেকে সফল মানুষ মনে করে লাক্কু মিয়া। মনে মনে নিজেকে নিঃশর্ত অভিযোগহীন দাবী করে প্রশান্তির একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে মনের একান্তই গভীর থেকে।
নিজের এ পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে এখন সব সময় খুব কম কথা বলার চেষ্টা করে সেটা যে কারো সাথেই হোক না কেন। তাছাড়া বেশি কথা বলার মতো অহংকার বা গৌরবের কোন ঘটনাই যেন তার জীবনে একটিও ঘটেনি। তবে ইদানিং মানুষের বলা কথা গুলো শুনতেও ভালোলাগে না তার। সব যেন অন্তঃসারশূন্য। জ্ঞানহীন মানুষদের জড় পদার্থের মতো মনে হয়।
এজন্য পরিচিতজনদের সাথে মেলা-মেশাও কমিয়ে দিয়েছে। ধুঁকে ধুঁকে সরকারী চাকুরীতে বয়সের সীমা-রেখা পেরুনোর পর শহরেও যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। ভাললাগে না কোন কিছুই। প্রতিদিন একই রাস্তা, একই মানুষের মুখ, একই দোকানপাট, চায়ের দোকান, পান সিগারেটের দোকান।
পরিচিত দোকানের চা গুলোও কেমন জানি পানসে হয়ে গেছে। তার উপর চায়ের দোকান গুলোতে বেশি দিন বেঁচে থাকার আশায় ফ্যাশানের মতো চিনি ছাড়া চা খাওয়া লোকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নিজের ভবিষ্যৎ রোগ-ব্যাধি ও মরণের চিন্তাটাও মাঝে মধ্যে মনের ভিতর ঘুরপাক খেতে থাকে।
লাক্কু মিয়া তখন ভাবে, ধুর মরণে তার আবার ভয় আছে নাকি? সেতো কবেই মরে গেছে। এখন আর মরলেই বা কি, বাঁচলেই বা কি? তাছাড়া চায়ের দোকানে বসলে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের পেচাল গুলোও বিষাদিত লাগে তার কাছে। নিজের জীবনের চেয়েও দলকে, নেতা-নেত্রীকে বেশি ভালোবাসার গল্প শুনলে পাছায় স্ব-জোড়ে লাথ্যি মারতে ইচ্ছে করে। রাজনীতির সংজ্ঞা না জানা এসব লোকরাই দেশটার বারোটা বাজিয়েছে।
এসব কিছু ভেবেই শহরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে লাক্কু মিয়া। এখন বাসাতেই রুমের ভিতর দিন রাতের বেশির ভাগ সময় কাটে তার। সরকারী চাকুরীজীবি অহংকারী বউটাকে ভালো না লাগলেও তার মন মানষিকতার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছে এটাই আসল কথা।
বউটাকে ভালো লাগে না বললে ভুল হবে, বউয়ের আচরণ ভালো লাগে না। মেধাহীন মনে হয়। কিন্তু সে কথা বললে ঝামেলা বাড়তে পারে, এজন্য বলা হয় না। বিয়ের আগে রাতভর মোবাইলে সোনা-পাখি, ময়না-পাখি বলে ডাকা আদরের কথাগুলো এখন প্রতারনার মতো মনে হয়। বিয়ের আগে বউকে উদার আর মহতি মনে হলেও এখন ভুয়া মনে হয় সব কিছুই।
লাক্কু মিয়ার মনে হয় বিয়ের আগে যে মেয়েরা তার প্রেমিককে কথায় কথায় বাবা-মায়ের খোঁজ খবর নিতে বলতো সেই মেয়েরাই বিয়ের পর কালক্ষেপন না করে শশুর-শাশুরির মুখে লাথি মেরে আলাদা সংসার পাতে। ভালোবেসে বিয়ে করা বউ আকতারি পারভিনের এমন আচরণ সত্যিই অবাক করে দিয়েছে তাকে। প্রাইমারীতে চাকুরী করা সকল মেয়ে মানুষরাই মনে হয় তার বউয়ের মতো।
লাক্কু মিয়া ভাবে, কথায় কথায় ডিভোর্সের হুমকি দেয়া এসব মহিলারা নিশ্চিত একদিন জাহান্নামে যাবে। শুধু মাত্র তিন বছরের মেয়ে উর্মিতা না থাকলে কবেই কপালে গুড়ি মেরে চলে যেত এমন অশিক্ষায় শিক্ষিত বউয়ের সংসার থেকে।
একমাত্র মেয়েটার কারনেই, মেয়েটার বাবা ডাকের কারণেই সম্ভব হয় নাই। তবুও পুরুষ হয়ে ঘরের মেয়েলি কিছু কাজ করার সময় ভীষন রাগ হয় তার। মনে হয় সব ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে অথবা রেখে দুরে কোথাও চলে যায় সে।
লাক্কু মিয়ার মনে পড়ে তার এই দজ্জাল প্রকৃতির বউ আকতারি পারভিনের জন্য মায়ের কত গালি খেতে হয়েছে তাকে। হারামজাদা, বউয়ের গোলাম। বউকে কিছু বলার সাহস নাই তোর। রাত হলে বউ গায়ে হাত দিতে দিবে না এই ভয়ে কিছু বলিস না। বের হয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। কুলাংগার কোথাকার।
গর্ভধারিণী মায়ের মুখে এসব কথা শুনে মাঝে মধ্যে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সাধ মিটে গিয়েছিল তার। রাতে দিনে অহরহ চলতো এসব বাক্য বিনিময়। বউ কথার মাঝে কিছু একটা বলে চুপ করে থাকতো। তারপর চলতে থাকতো গালিসহ অভিশাপের পালা।
হাজার হোক মা জননী। দশ মাস দশ দিন গর্ভে রেখেছিল তাকে। চুপচাপ সহ্য করতে হতো সবকিছুই। তবুও মাঝে মধ্যে মুখ ফসকে মায়ের কথার উত্তরে যেই বেরিয়ে যেত’ মা আজকাল সরকারী চাকুরীজীবি বউকে ইচ্ছে হলেও কিছু বলা যায় না। আর কোথায় যায়।
মায়ের পায়ের রক্ত যেন মাথায় উঠে যায়। গলার জোড় দ্বিগুণ বাড়িয়ে বলতে থাকে বউয়ের পা চাটা গোলাম। এই মুহুর্তে তোর বউ ছোয়া নিয়া বাড়ি থেকে বের হয়া যা। তোর মতো বেহায়া বেটার দরকার নাই আমার। তুই রাস্তা-ঘাটে পড়ে মর। এমন বউ বেটার কপালোত গুড়ি মারং বলার সাথে সাথে মাটিতেও দুইটা গুড়ি মারে।
এসময় বাবা নিশ্চুপ শ্রোতার মতো শুনতে থাকে। লাক্কু মিয়া জানে তার বাবা নওয়াব আলী একজন মাটির মানুষ। বউ ছালেহা বেগমের কথায় উঠবস করেন তিনি। দেখে মনে হয় সংসারে নওয়াব আলীর কিছু নাই। সব তার মা বাপের বাড়ি থেকে এনে সংসার পেতেছে। তার দয়ায় এ সংসারে বেঁচে আছে সবাই।
বাবা কিছু বললেই দাবাড় মেরে বলে, ছেলে বউকে শিক্ষা করতে পারে না আর আমার উপর খবরদারী। বাবার ভাত পর্যন্ত বন্ধ করারও হুমকী দিত মা জননী।
কিন্তু ছেলে-বউয়ের প্রতি মায়ের এই রাগের রহস্যটা ঠিক মতো বুঝতে পারে না লাক্কু মিয়া। বউ তার সংসারের কোন কাজের ধার ধারে না এজন্য নাকি অন্য কোন কারন। নাকি বউ তার বাড়িতে থেকে বসে শুয়ে খেয়ে খেয়ে চাকুরী করে পুটলি গোছায় এজন্য।
এই সাধারণ ঘটনায় মায়ের এতো রাগের কারণ কি তা আজও অজানা তার কাছে। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই তো দেখে আসছে এতো বেশি রাগের মহিলা ছিল না তার মা।
বউটাকে আনার পর কিছুদিন ভালোই ছিল। তারপর কেন যে এতো রাগ সব সময় খিচির-মিচির করতে থাকলো তা কে জানে।
এক পর্যায়ে বাপ-দাদার ভিটে মাটি ছেড়ে শহরের নিকটবর্তী ভাড়া বাসায় বউয়ের সাথে থাকতে বাধ্য হল লাক্কু মিয়া। বউ-মেয়ের সাথে থাকতে থাকতে মাঝে মধ্যে নিরীহ বাবা ও গর্ভধারীণী মায়ের জন্য মনটা খারাপ হয় তার। কিন্তু মায়ের পক্ষ নেয়া ছোট ভাইদের ন্যায় অন্যায় বলা কথা গুলো মনে পড়লে দুঃখ কিছুটা নিবারন হয়।
যে ছোট ভাইদের কোলে পিঠে মানুষ করেছিল সেই ভাইয়েরা যখন তাকে বালকামা, বেয়াদব, বউয়ের ভাড়ুয়া বলে গালি দিত। মায়ের কথায় মারতে আসতো পর্যন্ত। সেসব কথা ভাবলে এখনও চোখে পানি আসে তার।
লাক্কু মিয়া ভাবে, এমন মা ভাইয়ের সংসারে মর্যাদা নিয়ে থাকার চেয়ে গোপনে রুমের ভিতর ভালোবেসে বিয়ে করা বউটার ন্যায় অন্যায় কিল ঘুষিই অনেক ভালো। ভাবে সেতো আর রক্তের কেউ না। এজন্য বউয়ের কথায় এখন আর কোন দুঃখ বোধও হয় না তেমন।
অভিযোগহীন মানুষের মতো সোনার ডিম পাড়া বউয়ের কথায় কাপড় কাচা, তরকারী কোটাসহ রান্না-বান্নার কাজটাও নীরবে করে দেয়। ভাবে শুধু ভাগ্যের দোষে তার আজ এ অবস্থা।
নতুন সংসারে প্রথম প্রথম এসব করতে ভীষণ রাগ হতো লাক্কু মিয়ার। ভালোবেসে পাওয়া সাত রাজার ধন আকতারি পারভিনের সাথে রাগ করে কথাই বলতো না তিন দিন, সাত দিন এমনকি পনের দিন পর্যন্ত। বউ রাগ করে বাপের বাড়িতে গেলে মনের দুঃখে, ক্ষোভে খেয়ে না খেয়ে বিছানায় শুয়ে সময় কাটাতো। এসময় গুলোতে খুব রাগ হতো সৃষ্টি কর্তার উপর। কি প্রয়োজন পড়েছিল সৃষ্টি কর্তার তাকে দুনিয়ার মুখ দেখানোর।
আলাদা সংসারে থাকতে দুইবার রাগ করে ঢাকাও গিয়েছিল সে। একবারতো এক মাস পার হওয়ার পরও ফিরে আসেনি। পরে আবার জানি কেমন করে বউয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল বুঝতেই পারেনি।
মেয়েটার প্রতিতো মন টানছিলই, পাশাপাশি দুই তিন দিন পার হতেই কেমনে জানি বউটার প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল, মনের ভিতর শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। পরে সরকারী চাকুরীজীবি বউয়ের সামান্য ভালোবাসাই তাকে সংসারে ফিরিয়ে এনেছে।
তবে লাক্কু মিয়া মাঝে মধ্যে ভাবে তার নিজেরই বুঝি লজ্জা শরম কিছু নাই। তাছাড়া কি এমনই বা আছে আকতারি পারভিনের মাঝে শুধু সংসার চালানোর জন্য প্রতিমাসে বেতনের টাকা কয়টি ছাড়া। আর বেতনের টাকা কয়টা ব্যাংক থেকে তোলার পর নিজের বাবা-মা, ভাই-বোনের প্রতি দরদ যেন উছলে পড়ে। যেন তারা মেয়ের সরকারী চাকুরীর বেতনের দিকে চেয়ে আছে।
আগে প্রায় সময় এমন একটি সরকারী চাকুরী জোটাতে না পাড়ার ব্যর্থতায় নিজের উপর ধিক্কার দিত লাক্কু মিয়া। তার সকল যোগ্যতা থাকার পরও কেন সরকারী চাকুরী জোটাতে পারেনি সেটাও ভালো করে জানা আছে তার।
সে জানে চাকুরী নেয়ার জন্য অন্য দশজনের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্যতা আছে তার। সেকথা আকতারি পারভিনও জানে। শুধুই বালের রাজনীতি। এই রাজনীতিই জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে। রাজনৈতিক নেতা আর আমলারাই তাকে ভালোভাবে বাঁচতে দিল না। বাবা-মা, ভাই-বোনের সংসার থেকে তাকে আলাদা করে দিয়েছে। এজন্য আজ অবধি রাজনীতির প্যাচাল সহ্যই করতে পারে না সে।
লাক্কু মিয়া ভাবে একজন ভালো ছাত্রের গৌরব নিয়ে বেড়ে ওঠা যৌবনে রাজনীতি সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে পারে তা সে সময় বুঝতেই পারে নাই সে। যে গৌরবেই আকতারি পারভিনের মতো একজনকে বউ হিসেবে পেয়েছে। এখন বুঝছে সে গৌরবের লাভ কি ছিল? সে জানে প্রাইমারীর রিটার্ন পরীক্ষায় কয়েকবার টিকেও ভাইভায় আউট হয়েছে কিভাবে।
নারী কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর পোষ্য কোটার সুবাদে তার চেয়ে কম মেধার মেয়েরা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা, কিছু শিক্ষকের সন্তানও অনায়াসে সরকারী চাকুরীতে ঢুকে পড়েছে। আর সাধারণ কোটা হওয়ায় অনেক মেধা অর্জন করেও চাকুরী পায়নি সে।
এসব কথা মনে হলে আগে প্রায় সময় দেশের প্রধানদের বুদ্ধিজীবিদের মনে মনে গালি দিত লাক্কু মিয়া। দীর্ঘদিন ধরে মহিলারা দেশের প্রধান হওয়ায় মহিলাদের সুযোগ সুবিদা দিতে দিতে এই অবস্থা তার।
এখন নাকী শতকরা পচানব্বই ভাগ প্রাইমারী স্কুলে পুরুষ টিচার নাই। মহিলারাই সব শরীর চর্চা, খেলাধুলা থেকে শুরু করে সব কিছুই করে। আবার ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি। আর এতে করে প্রাইমারী শিক্ষিকাদের এমন ভাব বেড়ে গেছে যেন একেক জন শিক্ষিকা একেক জন মিনিস্টার, সচিব, উপ-সচিব, মহাসচিব হয়ে গেছে। পায়ের উপর পা তুলে, বিছানায় শুয়ে বসে স্বামীকে পিএস, এপিএস সর্বপরি স্কুলের পিয়নের মতো যখন তখন অর্ডার করে। নানা অজুহাতে শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে মিথ্যাচার করে নিজের বিবাহিত স্বামীর দ্বারা কাপড়-চোপড় পর্যন্ত পরিষ্কার করিয়ে নেয়।
সরকারী চাকুরীজীবি বউয়ের এসব চালাকী বুঝতে পেরেও কিছু বলার থাকে না লাক্কু মিয়ার। প্রথম প্রথম কষ্ট লাগলেও এখন আর কষ্ট পায় না। ভাবে নিজের মহামূল্যবান ইজ্জত বিক্রি করেই তো অভিযোগহীন মানুষ হতে পেরেছে সে। তবে এখন আর নিজের ভাগ্যের উপর দোষ চাপায় না। যেকোন ভাবেই হোক একটি মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট জোগাড় করতে না পারা জন্মদাতা বাপের উপরও অভিযোগ নেই তার।
এখন আর কারো প্রতিই কোন অভিযোগ নেই লাক্কু মিয়ার। সে ভাবে আসলে টাকাই মানুষের আত্মমর্যাদা খেয়ে ফেলে।
মাঝে মধ্যে মনকে শান্তনা দেয়ার ভাষাও অবশিষ্ট থাকে না। বুকের পাজর ছেদ করা বউয়ের বাকা কথাও এখন আর আহত করতে পারে না তাকে। বউটাকে জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে হলেও কখনও সেই বউয়ের ভালোবাসায় সিক্ত হতে হয় নিজেকে।
মাঝে মধ্যে রাতে বেড়াতে তার নিজের ইচ্ছে না থাকলেও খুব আপন করে, খুব ঘনিষ্ট ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে আকতারি পারভিন। এখনও সোনা পাখি, ময়না পাখি বলে দুর্বল করার কৌশলটা ভালই রপ্ত করেছে আকতারি। লাক্কু মিয়া তখন উপায়ান্তহীন মানুষের মতো বউয়ের কৌশল মেনে নিয়ে যৌবনের রসে সব ভুলে যায়।
তবে আগে নিজের ইচ্ছে মতো আকতারি পারভিনকে আদর সোহাগ করলেও এখন আর সাহস হয় না। কখন ফোস করে উঠবে কে জানে। তাছাড়া আস্তে আস্তে বউকে মনিব ভাবত ভাবতে সে ইচ্ছেটাও মাটিতে মিশে গেছে। লাক্কু মিয়া এতোদিনে একটি বিষয় উপলদ্ধি করেছে সেটা হলো মানুষের ভালো লাগা না লাগার সাথে সাথেই যৌবনের চাহিদাটাও উঠা নামা করে। আর এজন্যই হয়তো বা সেক্সের কামনা-বাসনা তেমন কাজ করে না তার মধ্যে।
তবে এখন নিজের বিবাহিত স্ত্রী, ভালোবাসার পাখিটাকে নষ্ট মেয়ে, মাগী বলে মন হয় তার। মনে হয় কারো না কারো সাথে দৈহিক সম্পর্ক আছে আকতারি পারভিনের। তা নাহলে রাত জেগে জেগে ফেসবুকে চেটিং করতে যাবে কেন? নাইট ড্রেসে ইমোতে ভিডিও কলে কথা বলবে কেন? জীবন্ত স্বামীকে রেখে অন্য কোন পুরুষের সাথে এভাবে কথা বলবে কেন?
এরই মধ্যে বউয়ের চরিত্র হননের মতো অনেকগুলো প্রমাণও পেয়েছে লাক্কু মিয়া। রাত জেগে চেটিংয়ের ধরন, হালকা পোষাকের ফাঁকে ভিডিওতে দেহ দেখানোর কৌশল, মুখের বিভিন্ন ভঙ্গিমাই সে প্রমাণের স্বাক্ষ্য বহন করে।
নিজের বউকে অন্য কেউ সোনা-ময়না পাখি বললে, ইমোতে কিস দিলে কেমন লাগে সেটা সে ছাড়া আর কেউ ভালো বুঝতে পারে না। তবুও সন্তানের দিকে তাকিয়ে নিজের বউয়ের সাথে এক বিছানায় রাত যাপন করে এই অভিযোগহীন মানুষটি। এই ভেবে যে একজন পতিতার সাথে রাত যাপন করলেও টাকার প্রয়োজন হয়। সেখানে আকতারি পারভিনের মতো একজন উচু মানের, বড় মনের শিক্ষিত মহিলার বিছানায় বিনা পয়সায় শোয়ার ভাগ্য তার হয়েছে। অভিযোগহীন একজন বেকার মানুষেরতো এটাই বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার।
হাইটালি | জুলকারনাইন স্বপন

হাইটালি | জুলকারনাইন স্বপন

হাইটালি | জুলকারনাইন স্বপন

কিছু কিছু স্মৃতি মানুষ অনেক দিন মনে রাখে বা সযত্নে লুকিয়ে রাখে মনের গভীরে। এমনকী সারাজীবন ধরেই বয়ে বেড়ায়। বিশেষ করে শৈশব, কৈশোরের স্মৃতিগুলো মানুষের মনে দাগ কাটে বেশি। আর শৈশব, কৈশোরের স্মৃতিগুলো হয় মূলত খেলার সাথি, নিজ গ্রাম বা তার আশপাশের মানুষগুলোকে ঘিরে। স্মৃতিগুলো মনে হলে এক অনাবিল শান্তিতে ভরে যায় মন। এক অপার্থিব ভালোলাগায় ভরে ওঠে হৃদয়। স্মৃতিগুলোকে মানুষ নিজের মতো করে ভালোবাসে। ভাবে, এটা শুধুই আমার।

এমন অনেক স্মৃতি আজও মনে পড়লে কাজলের মনটা চলে যায় অনেক দূরে। সেই শৈশব, কৈশোর এসে ভেসে ওঠে তার চোখের তারায়... সেই গ্রাম, যে গ্রামের ধুলোমাটিতে একসময় মাখামাখি হত তার সারা শরীর... সেই মেঠোপথ, যে পথের ঘাসের ওপর শিশিরবিন্দুগুলো টলমল করত... সেই গাছগাছালি, সেই পাখিরা, সেই নদী মনে হয় আজও তাকে কাছে ডাকছে।

হুতোমপ্যাঁচাগুলো কি এখনও গভীর রাতে ডেকে ডেকে বুকে ভয় ধরিয়ে দেয়? হাঁসগুলো কি এখনও খেলা করে নদীর জলে? গায়েন কাকা কি এখনও দোতারা হাতে আসর জমায়? নাকি তিনি আদৌ বেঁচেই নেই! করুণা মাসী কি এখনও মাছ ফেরি করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে? জয়নাল নানা কি ফোকলা দাঁত নিয়ে রসের গল্প বলেই চলছে?

 জেলেপাড়ার মানুষগুলো কেমন আছে এখন? এখনও কি বেলবাজারের মেলা বসে... রঙিন মার্বেল...?

কাজলের শৈশবের বেশি অংশটাই কেটেছে গ্রামে। কিন্তু কৈশোর পর্যন্ত তার সাথে গ্রামের সম্পর্ক ছিল নিয়মিত এবং নিবিড়। সে তার গ্রামকে খুব ভালোবাসত যেমন সন্তান ভালোবাসে তার মাকে। আর ভালোবাসবে না-ই বা কেন! এই গ্রামেই যে তার জন্ম। এই গ্রামের আলো-বাতাসের সাথে তার শৈশব কেটেছে। আর যে নদীতে সারাদিন লাফালাফি করে তার চোখ লালবর্ণ ধারণ করত, শেষে মায়ের হাতের পিটুনি জুটত, সেই নদীকে ঘিরেই কাজলের গ্রামের অবস্থান। সেই নদীর ওপর অনেকাংশে নির্ভর করত এই গ্রামের মানুষগুলো।

গ্রামের নাম সুবর্ণপুর। যেমন নাম তেমনই সুন্দর গ্রামটি। ঝকঝকে তকতকে ছিল প্রতিটি উঠোন, কিন্তু অন্য দৃশ্যও ছিল; সেটা অবশ্য জেলেপাড়ার। শহর থেকে অনেক দূরে সুবর্ণপুর। একটি বড়ো রাস্তা এসে সুবর্ণপুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে অন্য একটি হাটে। এই রাস্তা দিয়ে এক হাঁটু ধুলা মাড়িয়ে গাড়োয়ানরা মালবোঝাই গরুর গাড়ি হাঁকিয়ে হাটে যেত। তাদের কণ্ঠে থাকত ভাওয়াইয়া গান... ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত চলিম মুই পন্থে পন্থে রে... কিংবা ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে, কোনদিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও, কয়া যাও রে...। আশপাশের বাড়ির বউ-ঝিরা গান শুনে ঘোমটার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখত। গাড়োয়ানদের উদাস কণ্ঠের সেই গান যুবতীদের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলত। সেই অজানা, অচেনা গাড়িয়ালের ব্যথাতুর কণ্ঠের সুর তাদেরকেও ব্যথিত করে তুলত। তাদের ভাবনার জগতে গাড়িয়াল এক গভীর ছাপ ফেলত। ফলে তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত অজানা গন্তব্যের দিকে।

বড়ো রাস্তার পাশ ঘেঁষে সুবর্ণপুর গ্রাম। চওড়ার চেয়ে লম্বার দিকেই বেশি বিস্তৃত। সুবর্ণপুর গ্রামের পর কিছুদূর আবাদি জমি। কোনো বাড়িঘর নেই। তারপর জেলেপাড়া। যদিও জেলেপাড়াকে সুবর্ণপুর গ্রামেরই অংশ ধরা হয় তথাপি কেমন করে যেন জেলেপাড়া নিজেকে আলাদা করে ফেলেছে। জেলেপাড়ার কিছু বৈশিষ্ট্যই হয়তো বা জেলেপাড়াকে স্বতন্ত্র একটি রূপ দিয়েছে।

জেলেপাড়ার প্রতিটি বাড়ি ঝুপড়ির মতো নিচু, কোনোরকমে মাথা হেঁট করে ঘরে ঢুকতে হয়। আর ঘরের ভেতরে ঢুকলেই মনে হবে আলো-বাতাসহীন এক বিভীষিকাময় অন্ধকার কূপে যেন ফেলে দেয়া হয়েছে। দম বন্ধ হয়ে আসে স্বল্প পরিসরের সেই ঘরে। এই ঘরেই অনেকগুলো মানুষ একত্রে ঠাসাঠাসি করে বাস করে বছরের পর বছর, জীবনভর। একটি বাড়ি ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে আরেকটি বাড়ি দাঁড়ানো। অবশ্য বাড়ি বললে ভুল হবে, কোনোরকমে একটি চালাঘর। রান্নাবান্না হয় বাইরে, খোলা আকাশের নীচে। সকাল-সন্ধ্যায় প্রতিটি বাড়ির সামনে বাঁশ গেড়ে জাল শুকোতে দেয় তারা। ফলে জেলেপাড়াটি জালের বেড়া দ্বারা ঢেকে যায়। বাড়ির পেছনটা তারা কলাপাতা দিয়ে আড়াল করার বৃথাচেষ্টা করে। ফলে ঐ কলাপাতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে দিনে রাতে কুকুর-শেয়াল অনায়াসেই যাতায়াত করে। জেলেপাড়ার বাড়িগুলো পাশাপাশি থাকলেও একটি ঘর জেলেপাড়া থেকে দূরে যেন শূন্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের বাইরে যতটা না শূন্যতা তার চেয়ে বেশি শূন্যতা ঘরের ভেতরে। ঐ ঘর বা বাড়ির চারপাশে কোনো আড়াল নেই। চারদিকই খোলা। সুনসান। এই শূন্যতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ঐ বাড়ির পরের ধু ধু বালুচর। আর কোনো গ্রাম নেই, নেই কোনো প্রাণের স্পন্দন। করুণা মাসী এক অসীম শূন্যতা নিয়ে এই ঘরেই বাস করে। একলা। বিধবা। স্বামী মারা গেছে সাপে কেটে। জেলেরা যে মাছ ধরে, সেই মাছ নিয়ে করুণা মাসী বাড়ি বাড়ি ফেরি করে। কখনো নগদ পায়, আর বেশিভাগই ধানচালের বিনিময়ে। সেই ধানচালগুলো সে বিক্রি করে সুবর্ণপুর হাটে। করুণা মাসী জেলেপাড়ার যে প্রান্তে থাকে, তার অপর প্রান্তে কিছুদূর এগোলেই নদীটা যেখানে সোজা পুবদিকে বাঁক নিয়েছে, সেখানেই সুবর্ণপুর হাট।

সুবর্ণপুর হাট বসে শনিবার আর মঙ্গলবার। এই গ্রাম ছাড়াও আরও দু-এক গ্রামের লোকজন তাদের প্রয়োজনীয় খরচাপাতি করে এই হাট থেকেই। সুবর্ণপুর হাট খুব একটা বড়ো নয়। স্থায়ী দোকানপাট নেই বললেই চলে। একটি মাত্র দোচালা দোকান আছে, যার মালিক বয়তুল্লা। হাটবার ছাড়া দিনে দোকান খোলা থাকে না। সন্ধ্যার পরে কুপি জ্বালিয়ে দু-এক ঘণ্টার জন্য খোলা হয়। দোকানের সামনে বাঁশের ফালি দিয়ে একটি টং পাতা হয়েছে। সন্ধ্যায় যারা পান খেতে বা বিড়ি ফুঁকতে আসে, তারা এই টঙে বসে আড্ডা মারে, গল্প-গুজব করে। মাঝে মাঝে গায়েন কাকা এসে দোতারা হাতে গানের আসর জমায়। হাটের দিন অবশ্য সারা এলাকা জুড়ে দোকান বসে। কেউ বা মাদুর পেতে, কেউ বা খড় বিছিয়ে কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে হরেক রকম জিনিসের পসরা নিয়ে বসে। কেউ খেতের সবজি, ধান, চাল-ডাল, কেউ হয়তো তামাকপাতা, পানপাতা দিয়ে পসরা সাজায়। লবণ থেকে শুরু করে মাছ পর্যন্ত এই হাটে পাওয়া যায়, শুধু মাংস ছাড়া। গামছা, লুঙ্গিও বিক্রি হয় এই হাটে। বাপের হাত ধরে যে ছেলেটি হাটে আসে, তার চানাচুর, মোয়ামুড়ি বা গুড়ের জিলাপির আবদারও রক্ষা হয় এই হাটে। কেউ বা ভাঁড় সাজিয়ে, কেউ নৌকা করে মালামাল নিয়ে আসে। হাটের দিন, বিশেষ করে মঙ্গলবারের হাটের দিনে গ্রামে একটা সাজ সাজ রব তৈরি হয়। কামার, কুমার, জেলে, কৃষক সবাই দুপুর হতেই কাজ ছাড়ে। প্রস্তুতি নিতে থাকে হাটে যাবার।

সুবর্ণপুর হাটের এক পাশে বিরাট এক বটগাছ। বটগাছটি তার শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত করে ছাতার মতো দাঁড়িয়ে আছে। বটগাছ থেকে কিছু লতা এসে মাটিতে গেঁথে বসেছে। সেগুলোই এক-একটি পিলারের মতো। হাটের অপর পাশে জেলেপাড়া লাগোয়া বিরাট এক কালীমন্দির। তেরো হাত লম্বা এক কালীমূর্তি স্বমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। কালীমন্দিরের পাশেই বিরাট লম্বা এক শিমুল গাছ তার দম্ভ নিয়ে আকাশ ছোঁয়ার অপেক্ষায়। তার দম্ভকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক জোড়া টিয়েপাখি। গাছের কোটরে বাসা বেঁধেছে তারা। সকাল-সন্ধ্যা হইচই, ঝগড়াবিবাদ করে এলাকাটা সরগরম করে রাখে। কালীপুজোর সময় সুবর্ণপুর হাটসহ মন্দির চত্বর এলাকায় মেলা বসে, যার নাম বেলবাজার। পুজোর সময় হিন্দুরা এখানে মানত করে কবুতর, পাঁঠা বলি দেয়। তখন দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসে।
এই মেলার জন্য গ্রামের মানুষ সারাবছর তাকিয়ে থাকে। যার যা প্রয়োজন তার সবকিছুই এই মেলায় পাওয়া যায়... আটা-চালা চালুনি থেকে দাদিমার সুপারি পেষার উড়–ন, ডালি, কুলা, হাঁড়িপাতিল, রসুন, মসলা... পরানবাবু বছরে একবার ধুতি কেনেন, তাও এই মেলায়... নাকের নথ, মাথার টিকলি, লালফিতা, নীলফিতা, লাঙলের ফলা, দা, কুড়াল, পাটের ছিকাই- স-ব। লাল-নীল রঙের মার্বেলের আকর্ষণে ঘুম ধরে না যে ছেলেটির, তার মুখে হাসি ফোটে মেলায় এলে। আর কত রকমের খাবারদাবার। মিষ্টি, গজা, তালমিছরি, বাতাসা, তিলের খাজা, খোরমা ইত্যাদি। গ্রামের কিশোরী মেয়েরা মেলায় আসে দল বেঁধে। আনাড়ি হাতে মা-বোনের রঙিন শাড়ি পরে কোনো কারণ ছাড়াই খিলখিল করে হাসতে হাসতে তারা মেলায় আসে। রঙিন চুড়ি, কোমরের বিছা, আয়না, তিব্বত স্নো তারা কিনবেই। এই মেলার সময় সুবর্ণপুরসহ আশপাশের গ্রাম সরব হয়ে ওঠে। জেলে তার জাল ছাড়ে, হালুয়া তার হাল ছাড়ে। সবাই এক উৎসবে মেতে ওঠে।

সুবর্ণপুর গ্রামসহ চারপাশের গ্রামের মানুষজনের জীবনযাপন, জেলেদের জীবিকানির্বাহ, উৎসব সবকিছু যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় সে আর কেউ নয়- হাইটালি। একটি নদী। শাখানদী। একসময় যৌবনকালে দু-কূল ছাপিয়ে জল উছলিয়ে পড়ত। শুকনো মৌসুমে পানির স্তর নেমে যখন প্রায় হাঁটু-সমান হত, তখন মানুষ নৌকা ছাড়াই এপার-ওপার করত হেঁটে হেঁটে। কাপড় না ভিজিয়েই এই নদী তখন পার হওয়া যেত। সেই থেকেই এই নদীর নাম হয়ে যায় হাইটালি।

হাইটালির পানি দিয়েই এলাকার চাষাবাদসহ সকল কাজ হয়ে থাকে। জেলেরা ডিঙি ভাসিয়ে মাছ ধরে সকাল-বিকাল-রাতে। সেই মাছ বিক্রি হয় গ্রামে গ্রামে, হাটে হাটে। এই নদীতেই ডিঙি ভাসিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে যায় দূর থেকে বহুদূরে। কখনো দুই দিন, কখনো তিন দিন তারা ডিঙিতেই থাকে, খায় দায়। এই হাইটালি যোগান দেয় অনেকগুলো মানুষের জীবন বাঁচার রসদ। চাষিরা সকালবেলা এই নদী পার হয়ে ওপারে যায় ক্ষেতে কাজ করতে। আবার ফসল তুলে ডিঙি দিয়ে নিয়ে আসে এপারে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ডাঙায় গোল্লাছুট, ছি-বুড়ি খেলে যতটা না আনন্দিত হয়, তার চেয়ে বেশি মজা পায় হাইটালির পানিতে দাপাদাপি করে। তারা শাপলা-শালুক তোলে পরম আনন্দে, ছিপ দিয়ে মাছ ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গাঁয়ের বউ-ঝিরা কাপড় কাচতে এসে উদাস হয়ে বসে থাকে হাইটালির পাড়ে। শেষে অবেলায় গোসল সেরে ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফিরে শাশুড়ি অথবা মায়ের বকুনি। রাখালরা তাদের গরু-ছাগলকে পানি খাওয়ায় এই নদীতে। তারপর সেগুলোকে গোসল করিয়ে গাঁয়ের পথ ধরে। সকালবেলা থালাবাসন মেজে কলসিতে পানি ভরে ঘোমটার ফাঁকে এপাশ-ওপাশ দেখতে দেখতে চঞ্চলা হরিণীর মতো চলে যায় নতুন বউ। এই হাইটালিই পানির যোগান দেয় এই অঞ্চলের অধিকাংশ প্রাণীকুলের। নৌকায় পাট বোঝাই করে মাঝিরা গান গাইতে গাইতে চলে যায় কোনো এক হাটে বা বন্দরে।

কিন্তু সেই হাইটালি এখন যৌবন পেরিয়ে পড়তি বয়সে। বয়সের ভারে সে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণকায় হয়েছে। তার প্রাণ জল, সেই জল আর প্রবাহিত হয় না তার বুক চিরে। সে বুকে এখন জেগেছে চর। শুকনো বালুচর। সে বালুচরে না জন্মে ঘাস, না জন্মে ফসল। কাজল কি জানে হাইটালির এই করুণ পরিণতি? সে কি শুনতে পায় তার হৃদয়ের কান্না? হাইটালির তীব্র আর্তনাদের কথা কাজল কি জানে? সে কি অনুভব করতে পারে হাইটালির কষ্টের তীব্রতা? হাইটালির কান্না, আহাজারি ভেসে বেড়ায় এখন সুবর্ণপুর গ্রামের আকাশে-বাতাসে। হায় হাইটালি...!
নিশান | রানা ভিক্ষু

নিশান | রানা ভিক্ষু

নিশান | রানা ভিক্ষু

শহরে এসে খাবার হোটেলে মেসিয়ারের কাজ পেয়েছে হামিদ। এটো টেবিল মোছা তার কাজ। সকাল থেকে রাত দাঁড়াবার জো নাই। প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠতে হয়। পরাটার জন্য বানানো ডাল দিয়ে গরম ভাত, এই হলো প্রতিদিনের সকালের নাস্তা। ভাতের সাথে মাছ ও মাংসের জন্য বানানো কৃত্রিম ঝোলের সাথে সবজি অথবা ভুনা ডিম দিয়ে দুপুরের খাবার। আর বেশিরভাগ রাতে খাওয়ার রুচিই থাকে না হামিদের। মধ্যরাতে হোটেলের সাঁটার বন্ধ করা হলে পেট ভরা গ্যাসের ঢেকুর তুলতে তুলতে হামিদ ঘুুমাতে যায় টেবিল জোড়া লাগিয়ে। এই খাওয়া ও থাকার খরচ কেটে নিয়ে মাসে সাতশ’ টাকা বেতন পায় হামিদ।

শুধু হামিদ নয়, সেকেন্দার, রব্বানী, কালু, জাহাঙ্গীর, কেকারু মিলে পাঁচজন হোটেলেই রাত কাটায়। তবে সব থেকে জুনিয়র হামিদ। হামিদ যেদিন এখানে কাজ শুরু করেছে তার ক’দিন পরেই অদ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটলো তার স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবনে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে কয়েকজন এসে প্রত্যেককে একটি করে সাদা গেঞ্জি আর একটি করে লাল ‘নিশান’ দিল। বলল- এগুলো পরে কাল মিছিলে যেতে হবে। দুপুরে আলোচনা সভা হবে, সভা শেষে গান। সভায় বক্তৃতা দিতে ঢাকা থেকে কে যেন আসবেন, অতিথির নাম-পদবি গেঞ্জি ও নিশান বিতরণকারী লোকগুলোও জানে না। সবার কাছ থেকে চাঁদা ধরা হলো পঞ্চাশ টাকা। হোটেল মালিক চাঁদা পরিশোধ করে দিল, সবার বেতন থেকে কেটে রাখার শর্তে।

হামিদ জানে না কিসের মিছিল। ওদের মধ্যে কালু স্কুলে পড়েছিল। গেঞ্জির বুকে লাল রঙে লেখা ‘মহান মে দিবস’ কথাটি তার মুখেই শুনলো হামিদ। কথাটির অর্থ কী, কেন মিছিল, কেন গান এসবেব কিছুই জানে না সে। অন্যদের কাছে যা শুনল তার সারমর্ম হলো- ‘এদিন বেশ আনন্দ হয়। সাদা-গেঞ্জি আর লাল-নিশান পাওয়া যায়। ট্রাকে তুলে মিছিল করতে করতে নিয়ে যায় আলোচনাসভায়। সভা শেষ হলে খিঁচুরি খাওয়ায়। সন্ধ্যায় হয় গান। এদিন কোনো কাজ করতে হয় না।’

এসবের কোনো কিছুই অর্থবহ হলো না হামিদের কাছে। গ্রামে সে একবার মিছিল দেখেছে ভোটের সময়। মিছিলের সামনে ছিল এক ছোকরা। সারা শরীরে গাছের পাতা ঝুলিয়ে নানা ভঙ্গিমায় সে নেচে নেচে চলছিল। ভাঙা প্লেট বা পাতিল, যে যাই পেয়েছে তাতে গাছের ডাল কিংবা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঝনাৎ-ঝন্ শব্দ তুলে গ্রামবাসীরা ছোকরার পিছে পিছে সারা গ্রাম ঘুরেছে। দু’জন লোকের হাতে ছিল বাঁশের লাঠি। লাঠির মাথা ঝাজরা করে মাটির ‘সারোয়া’ শক্ত করে বাঁধা হয়েছিল। সারোয়া তে ছিল কিরোসিনে ডোবানো পাটের ‘হাপাল’। দাউদাউ করে আগুন জ¦লছিল হাপালে। ভাঙা প্লেটে একই তালে ঝনাৎ-ঝন্ শব্দের সাথে সবাই চিৎকার করে বলছিল- ‘মশাল’, ‘মশাল’, ‘মশাল’.....। সে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই ছিল খালি গা। মিছিল যেদিকে যাচ্ছিল, সেদিকের বাড়ি থেকে, মাঠের কাজ ফেলে রেখে লোকজন সামিল হচ্ছিল মিছিলে।

আর ‘আলোচনা সভা’ কি, তা হামিদ জানে না। তবে একবার ওদের গ্রামের স্কুল-মাঠে রাতে বায়োস্কোপ দেখানো হয়েছিল। বায়োস্কোপে সে একজনকে কাঁদতে দেখেছে। লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল উঁচু জায়গায়। সামনে লাখ লাখ মানুষকে পিঁপড়ের মতো দেখা যাচ্ছিল বায়োস্কোপে। সবার হাতে ছিল লাঠি। কয়েকজনের সাথে দাঁড়িয়ে লোকটি বলছিল- ‘‘ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি...’’। লোকটি কিছু কথা বলে আর চশমা খুলে চোখের পানি মুছছিল। হামিদ তার কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারেনি। কিন্তু হামিদেরও গলার ভেতর কু-লি পাকিয়ে কান্নার উপক্রম হয়েছিল।

তাহলে কালকে হামিদকে কি সেখানেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কিন্তু তাদের গ্রামের ভোটের মিছিলে কিংবা বায়োস্কোপের জনসভায় অংশীজনদের সবাইকে সাদা-গেঞ্জি, লাল-নিশান তো পরতে দেখেনি হামিদ। আবার দুপুরে খিঁচুরি খাওয়ানো, রাতে গান, এসবের কোনো কল্পচিত্র আঁকতে পারল না হামিদ। তবে সে খুবই উৎসুক। ভোর হয়েছে ভেবে রাতে দুই-তিনবার ঘুম ভেঙে গেল। সকালের আগেই সবাই গোসল সারলো। নতুন গেঞ্জি পড়ল, মাথায় বাঁধলো লাল ফিতে। কিন্তু গেঞ্জিটি হামিদের হাঁটু পর্যন্ত নেমে আসলো। মনটা খনিক খারাপ হলো তার। বোতাম ছেঁড়া ময়লা জামাটি গায়ে দিল হামিদ, মাথায় শক্ত করে বাঁধলো লাল নিশান। সবার সাথে সেও ট্রাকে উঠল। ট্রাক গিয়ে থামলো একটা চৌরাস্তা মোড়ে। সেখানে সে একজনের বিরাট আকারের ছবির দেয়াল দেখতে পেল। লোকটাকে তার চেনা মনে হলো খুব। এই শহরে আসার পর এই প্রথম একজন চেনা মানুষের নাগাল পেল সে। তবে ইনি কে তা মনে করতে পারছে না হামিদ। অনেক চেষ্টা করে হামিদের মনে পড়ল- হ্যাঁ ইনিই সেই লোক, যাকে সে বায়োস্কোপে দেখেছিল।

কালু’র কাছে জানতে পারল এনার নাম ‘বঙ্গবন্ধু’। সেদিন থেকে কারো মুখে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটি শুনলে হামিদের মনে হয়- এই শহরে অন্তত একজন ব্যক্তি আছেন, যাকে সে চেনে। হামিদ প্রায়ই মনে মনে ভাবে শহরে নিশ্চয়ই সে কোনোদিন ‘বঙ্গবন্ধু’র সাথে দেখা পাবে....। হঠাৎ ট্রাক স্ট্রাট করলে কে যেন একজন চিৎকার করে বলে- ‘দুনিয়ার মজদুর’......। সবাই তার জবাবে কী যেন বলল। হামিদকে চুপচাপ থাকতে দেখে  কালু তাকে কিছু স্লোগান শিখিয়ে দিল। যখন নেতা বলবে- ‘দুনিয়ার মজদুর’, তখন তাকে বলতে হবে- ‘এক হও, লড়াই করো’। নেতা যখন বলবে- ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’, তখন বলতে হবে- ‘লড়াই করে জিততে চাই’। নেতা বলবে- ‘এই লড়াইয়ে জিতবে কারা’, বলতে হবে ‘কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা’। কয়েকবার বলতে বলতে স্লোগান রপ্ত হয়ে গেল হামিদের। গলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে স্লোগান দিচ্ছে। অনেক কথার অর্থ সে বোঝে না ঠিকই কিন্তু রক্ত যেনো তার টগবগ করে উঠছে!

দুপুরে ট্রাক পৌঁছালো বিশাল এক জনসমুদ্রে। সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না হামিদ। চতুর্দিকে মাইক বাজছে। যিনি কথা বলছেন তার কণ্ঠস্বর এমন, যেন মাইক না-থাকলেও কথা শোনা যেত। মাইকের শব্দে বিরক্ত হলো হামিদ। তাছাড়া এত লোক বক্তার মুখই দেখা যাচ্ছে না। মাঠের শেষদিকটায় তারা দাঁড়িয়ে ছিল। পাশে একটা বট গাছ। অনেকে গাছে উঠে মঞ্চের লোকজনকে দেখছে। হামিদও তরতর করে উঠে একটা মোটা ডালে বসল। বড় একটা লাল ‘চকি’র মধ্যে বসে আছে জনা কুড়ি লোক।  চকির পেছনে লাল কাপড়ে কাস্তে, হাতুরি আর মুষ্টিবদ্ধ হাতের ছবি আঁকা। সবার গায়ে সাদা-গেঞ্জি আর মাথায় ও হাতে লাল-নিশান বাধা। একজনের পর আরেকজন উঠে উঠে কথা বলে আবার চকি’র উপর বসছে। হামিদ তাদের কথার মাথা-আগা কিছু বুঝছে না। উপরন্তু মাইকের বিকট শব্দে কানো ভো ভো ছাড়া কোনো অর্থবহ শব্দ পাচ্ছে না। তার চোখে ভাসছে তার নিজ গ্রাম ‘ঢিংটারী’র বিশাল কদম গাছটির কথা। বাদুর ঐ গাছের কদম যতটা খায়, তার দশগুন বেশি খায় গ্রামের ছেলেমেয়েরা। চোখ বন্ধ করে সেই কদমের স্বাদ আর গন্ধ পাচ্ছে হামিদ। দেখতে পাচ্ছে  ছোটো বোন ‘পারুল’সহ তোতা, দুলু, বিষ্ণু, ইলিয়াস, মানিক, শংকর, আমিন, মালতি, কাজলা ... সবাইকে।

একসময় লাল-চকি থেকে লোকজন নেমে গেল। চকিতে উঠেছে আরেক দল মানুষ। তাদের হাতে অনেক কিছু। হামিদ কেবল ঢোল আর হামমোনিয়ামটাই চিনলো। তবে এখানকার ঢোলগুলো কমন যেন ছোটো ছোটো। ঘাড়ে না ঝুলিয়ে টেবিলে বসিয়ে ঢোল বাজানো দেখে বেশ মজা পেল হামিদ। একজনের হাতে মাছ ধরা ‘ডারকি’র মতো একটা যন্ত্র। মহিষের শিংয়ের মতো লম্বা লম্বা তিনটা বাঁশি তিনজনের হাতে। ‘তুম্মা কদুর বস’ এর মতো তিনটা খোল নিয়ে একটা লোক যাদুকরে মতো পটাপট বাজাচ্ছে। এখন হামিদের কিছুটা ভালো ভাগছে। খাটো করে এক লোক লম্বা চুল দুলিয়ে গান ধরলো- ‘চম্পা ফুটিলো চামেলি ফুটিল, তার সুবাসে ব্যাকুল এমন নাচিলো রে...। হামিদ হঠাৎ খেয়াল করল অনেকেই মাঠ থেকে চলে যাচ্ছে। হামিদ নিচে তাকিয়ে ‘সেকেন্দার, রব্বানী, কালু, জাহাঙ্গীর, কেকারু’ ছাড়াও হোটেলের অন্য ছেলেদের কাউকে দেখতে পেল না। হামিদের গা শিউড়ে উঠল। সে এখন কার সাথে ফিরবে?

একবার সে বেতগাড়ি হাটে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। পরে বুদ্ধি খাটিয়ে ‘ঢিংটারি’ যাওয়ার রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রামের অনেক লোকের দেখা পেয়েছিল। কিন্তু এখানে যেসব রাস্তা এই বিশাল মাঠে মিলে গেছে, সেগুলোর সবগুলোকে একইরকম মনে হলো হামিদের। মাঠ থেকে বেড়ানোর আটটি রাস্তা খুঁজে হামিদ আরো দিকভ্রান্ত হয়ে গেল। কোনপথে পা বাড়াবে সে? এবার সে অন্য আরেকটা বুদ্ধি খাটানোর চেষ্টা করলো। যে ট্রাকে এসেছে সেই ট্রাকটিকে খুঁজলো। কিন্তু ট্রাকগুলোও তো দেখতে একইরকম! আন্দাজ করে একটি ট্রাকে উঠে পড়ল সে।

রাত এগারোটায় ট্রাক শহরে এসে বিভিন্ন মোড়ে দাঁড়িয়ে লোকজনকে নামিয়ে দিল। কিন্তু কোনো মোড়ই হামিদের পরিচিত নয়। বঙ্গবন্ধু’র প্রতিকৃতি ছিল যে মোড়ে সেটিও চোখে পড়ল না। কাঁদতে শুরু করলো হামিদ। ট্রাকের হেলপার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে নিজের নাম ‘হামিদ’ আর গ্রামের নাম ‘ঢিংটারী’ ছাড়া কোনো উত্তরই দিতে পারলো না। তবে সে সব খুলে বলল- চার দিন আগে সে গ্রাম থেকে শহরে এসেছে, হোটেলে টেবিল মোছার কাজ পেয়েছে, হোটেলেই রাতে থাকে, মাসিক বেতন সাতশ’ টাকা ইত্যাদি। সবশুনে হেলপার শহরটির নাম জিজ্ঞেস করলে হামিদ তালগোল পাকিয়ে ফেলল। একবার মনে হলো রংপুর শহর, পরক্ষণে ভাবল বগুড়া হতে পারে, আবার মনে পড়ল ঢাকা শহরের নাম। তাই সে শহরের নাম না বলে বলল- ‘যে শহরের চৌরাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধু’র বড় একটা ছবি বানাইছে, সেই শহর।’ হেলপার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে ড্রাইভারের শরনাপন্ন হলো।

সব শুনে ড্রাইভার রাতে গ্যারেজেই থাকার ব্যবস্থা করলো হামিদের। পরদিন থেকে গ্যারেজের পাশে ‘পাভেল ব্যাটারি সার্ভিসিং’-এ শুরু হলো হামিদের ভিন্ন কর্মজীবন। গাড়ি থেকে ব্যাটারি ডাউন করা, এসিড পাল্টানো, পানি ভরানো, ব্যাটারি চার্জ করা, ব্যাটারি আপলোড করার কাজ হয় এখানে। তবে হোটেলের চাইতে তার ভালোই লাগলো। হোটেলে এঁটো টেবিল মুছতে মুছতে হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে সাদা ঘা হয়েছিল। টেবিল মোছার পর খাবারের আঁশটে গন্ধে ঘিনঘিন লাগতো। এখানে  তার কাজ নির্ধারিত হলো- দোকানঘরের মেঝে ঝাড়– দেওয়া, ওস্তাদের পানের খিলি কিনে আনা, এটা-ওটা এগিয়ে দেওয়া আর ওস্তাদের কাজ দেখে দেখে কাজ শেখা। বিনিময়ে কোনো বেতন-ভাতা পাবে না, পাবে তিন বেলা খাবার আর দোকানঘরে ঘুমানোর সুযোগ।

এটাকেই ভক্তি ভরে মেনে নিল হামিদ। মনে মনে স্থির করলো, এখানে তো আর বেশি দিন থাকছে না সে। পরিচিত কারো দেখা পেলেই গ্রামে ফিরে যাবে। মা ও আর ছোটো বোন পারুলকে এখন মিস করছে খুব। মা কাজে বের হয়ে গেলে পারুল কার সাথে খেলে। হামিদ না থাকায় খেলার সময় সবাই ‘পারুল’কে মারে না তো? অথবা বেঈমানী করে পারুলকে হারিয়ে দেয় নাতো? না, সে এখানে থাকবেই না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে গ্রামে ফিরবেই। গ্রামের পরিচিত কারো দেখা না পেলে অন্তত আবার যেদিন ‘সাদা-গেঞ্জি’ পরে আর লাল-নিশান মাথায় বেঁধে জনসভায় যাবে, সেদিন সে হোটেলের সেকেন্দার, রব্বানী, কালু, জাহাঙ্গীর, কেকারুদের খুজে বের করবেই। তারপর হোটেলে ফিরে গিয়ে হোটেল মালিককে বলবে তাকে গ্রামে ফিরিয়ে দিতে আসতে।

মাস তিনেকের মধ্যে হামিদের ভেসে ওঠা বুকের পাজরের হাড্ডির ওপর চর্বি জগাতে শুরু করছে। এখনো হাড্ডিগুলো দেখা যায় কিন্তু গণনা করার মতো আর স্পষ্ট নয়। গায়ের রঙটাও আরো কালো হয়েছে কিন্তু ত্বকে তৈলাক্ত ভাব চকচক করছে। একরকম কেটেই যাচ্ছিল হামিদের। অল্পদিন পরে আবার বিধি বাম হলো। একটা ব্যাটারি তুলে এনে রাখতে গিয়ে হাত থেকে ছিটকে পড়ল। ব্যাটারি ফেটে এসিডে ভিজে গেল হামিদের মুখ, গলা, বুক আর পেট। দোকান মালিক তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে কোনমতো বারান্দায় ফেলে রেখে কেটে পড়ল।
তখন হামিদ অজ্ঞান। ঘণ্টা দুয়েক পড়ে থাকলো জরুরি বিভাগের বারান্দায়। কে তাকে ভর্তি করাবে? কিভাবে? গোলাপী বাসফোর ঝাড়– দিতে এসে বেওয়ারিশ লাশ ভেবে দূর থেকে মেঝে ঝাড় দিল। তারপর বারান্দার বসে পান চিবাচ্ছে। হঠাৎ দেখল লাশটি নড়াচড়া করছে। ছুটে গেল কাছে। নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখল নিঃশ্বাস চলছে। ছুটে গেল ভর্তি কাউন্টারে। বলল- ‘রে বাবু, মাটিতে লাশ লয়, বাচ্চাটি তো বাঁচিয়া আছে। হা, বাঁচিয়া আছে। বেবস্তা করো। ভরতি করিয়া লও’।

গোলাপী বাসফোর ছুটো ছুটি করে হাসপাতালে ভর্তি নিশ্চিত করলো। চিকিৎসা শুরু হলে ঔষধ-পথ্যের দরকার হলো। গোলাপী সাধ্যমতো চেষ্টা করলো কিন্তু কুলাতে পারলো না। গোলাপী’র পীড়াপীড়িতে হাসপাতাল সমাজসেবা এগিয়ে এলো। তিনমাস পর হাসপাতাল থেকে নাম কাটা হলো হামিদের। দু’চোখের পাতা ছাড়া সারা মুখের চামড়া ঝলশে বিকৃত হয়েছে। শ্বাসনালী পুড়ে কী সমস্যার কারণে হামিদ আর কথাও বলতে পারে না। পেটের চামড়ায় টান পড়ায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। এখন হামিদ যাবে কোথায়? গোলাপী জলকর সুইপার কলোনীতেই নিয়ে এলো হামিদকে। গোলাপীর স্বামী ‘রংলাল’ স্পিরিট খেয়ে কেবল ফিরেছে। গোলাপীর সাথে বিকৃত হামিদকে দেখে রেগে বলল- ‘মাগী হামি তুমার স্বামী আছে। তুমহার নাঙ কেনে লাগিবে, হা?’

রংলালের নেশা কেটে গেলে গোলাপী সব খুলে বলল। রংলালের মায়া হলো। হামিদের কাছে গিলে বলল- ‘বাবু, হামারা মেথর আছি। তুমহার সাকিন কাহা?’

হামিদ কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু গো গো শব্দ ছাড়া কিছুই বের হলো না। রংলাল বলল- ‘‘মেথর পট্টীতেই তোমার সাকিন হবে বাবু। হা। কোনো ছমোৎসা হবেক লয়। হা হবেক লয়।’’ হামিদ কিছু বলতে পারল না। হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকলো। দু’গাল বেয়ে মাটিতে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ল চোখের পানি। রংলালও কান্না সংবরণ করতে পারল না দু হাতে মুছে নিল নিজের চোখ।

অনেক দিন পর একদিন হামিদ দেখলো সুইপার কলোনীতেও সবার জন্য সাদা-গেঞ্জি আর লাল-নিশান এসেছে। পরদিন কেউ কাজে যাবে না। সাদা-গেঞ্জি আর লাল-নিশান পরে অনেকে যাবে মিছিল ও জনসভায়। গোলাপী হামিদকেও পড়িয়েছে সাদা-গেঞ্জি। দুই হাতে আর মাথায় বেধে দিয়েছে লাল-নিশান। রাস্তার পাশে হামিদকে চটের উপর বসিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে গোলাপী ও রংলাল দুজনেই। যারা মিছিল ও  জনসভায় যাবে তারা একে একে জড়ো হচ্ছে। মিস্ত্রিপাড়া থেকে একটা মিছিল আসছে। সুইপার কলোনীর বাসিন্দারা এই মিছিলের সাথে যুক্ত হয়ে জনসভায় যাবে।

মিছিল যতই কাছে আসছে ততই কাঁদছে হামিদ। আজ তার মিছিলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। ইচ্ছে ছিল জনসভা থেকে খুঁজে বের করবে হোটেলের ছেলেদের। তারপর ফিরে যাবে মায়ের কাছে। ছোট বোন পারুলের কাছে। মিছিলে যখন স্লোগান উঠছে ‘দুনিয়ার মজদুর’ কিংবা ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’ কিংবা ‘এই লড়াইয়ে জিতবে কারা’- সব স্লোগানের প্রতিস্লোগান দিচ্ছে হামিদ, যথাসাধ্য জোরে। কিন্তু গো গো শব্দ ছাড়া কিছুই বের হচ্ছে না। হামিদ চিৎকার করে গো গো করছে আর দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি।

চটে বসে কাঁদতে দেখে মিস্ত্রিপাড়া থেকে আসা মিছিলের কে যেন একটা পাঁচ টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়েছে হামিদের দিকে। তখনই ক্ষেপে উঠেছে রংলাল বাসফার- ‘রাম রাম রাম, হামারা ফকির লয় রে বাবু। হামারা কাজ করিয়া খাই। হামারা সুইপার আছি হা। তু লিয়ে যা গা টাকা’। রাগে রক্তবর্ণ চোখ কোঠর থেকে যেনো বেড়িয়ে আসছে রংলালের। হাতে ও মাথায় বাঁধানো কাস্তে-হাতুরি ও মুষ্টিবদ্ধ হাত খচিত লাল নিশান ঝাঁকিয়ে রংলাল আবারো বলল ‘হামারা ফকির লয় গা হা...’।
সুতা ছেঁড়া স্বপ্ন ঘুড়ি | সম্পা রায়

সুতা ছেঁড়া স্বপ্ন ঘুড়ি | সম্পা রায়

সুতা ছেঁড়া স্বপ্ন ঘুড়ি | সম্পা রায়
ধাপগাছের আকাশে সূর্য ওঠেনি। কেবল আলোর আভাস দেখা দিয়েছে। লিচুতলা মসজিদ হতে আজানের আওয়াজ মিলিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। রাতশেষের বার্লিটা গরম করে মেয়েটাকে খাইয়ে দিয়ে নূরী দরজার খিলটা খুলল। শেষবার দেখে নিল মেয়েটাকে। তারপর এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে গেল সিদ্দিক কাকার আলুক্ষেতের দিকে। দক্ষিণ আলের পুব মাথার আলগা মাটিগুলো সরিয়ে বের করে আনল ব্যবহারের পর পুতে রাখা খালি কীটনাশকের বোতলগুলো। কৌটার মুখ খুলে বিষের শেষ বিন্দু পর্যন্ত ঢেলে জমা করল একটাতে। দেখার চেষ্টা করল কতটুকু জমেছে। মরার মত বিষ হবে তো? হায়রে জীবন! বাঁচার মত বিষ বস্তু মেলেনা, জোটেনা মরার বিষও। মৃত্যুর কথা মনে পড়তেই মেয়েটার মুখটা ভেসে উঠল বোতলের তলায় পরে থাকা বিষটুকুর মধ্যে। মায়াভরা মুখে তাকিয়ে আছে। দুধ নয়, ভাত নয়, শুধু কাছে চায়। হঠাৎ মনে হয় কাঁদছে মেয়েটা। বোতলগুলো ফেলে উন্মাদের মত ছুটে আসে নূরী। খোলা দরজাটার কাছে এসে দেখে তখনো ঘুমে মেয়েটা। কাছে যায়। ডুকরে কেঁদে ওঠে। প্রচণ্ড বাঁচতে ইচ্ছে করে। মেয়েটাকে এভাবে রেখে মরতে পরবে না ও। ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে তুলে নেয় নূরী। বাড়ন্ত সীম লতার মত জড়িয়ে যায় মেয়েটা ওর দেহের সাথে। কার কাছে থাকবে মেয়েটা? ছুরত আলী ওকে দিয়ে যা করাতে চাইছে, মেয়েটাকে দিয়েও কি..? ভাবতে পারেনা নূরী।

পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা নূরী বেগম স্বামী ছুরতের কাছ থেকে কি কারণে পালিয়ে এসেছিল ধাপগাছের লোকেরা তা জানেনা। কাউকে বলতেও পারবেনা নূরী। লজ্জা, ঘৃণা আর ক্ষোভের আগুনে দগ্ধ হয়েছে। কাউকে বলেনি, এমনকি ওর মাকেও বলেনি। ভালবেসে বিয়ে করেছিল নুরী ছুরৎ আলীকে। কিন্তু পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল সে। নিত্য অভাবী মায়ের কাছে আসতে ভীষণ খারাপ লেগেছিল ওর। কিন্তু সম্মান বাঁচাতে পেরেছিল। তাছাড়া শরীরের এ অবস্থায় মায়ের কাছে থাকতে পেরে বেশ খুশী ছিল।

জন্মালো পরী। ফুটফুটে ছোট্ট পরীকে দেখে নূরীর মা দিয়েছিল এ নাম। পর্যাপ্ত বুকের দুধ ছিলনা। তাই একটু বার্লি আর বিচি কলা ঘষে খাওয়াতে শুরু করলো নূরী। এভাবে বড় হতে থাকল নূরীর সাত রাজার ধন। পরী বোল ধরেছে। দা..দা, বা..বা..। রাগে জ্বলে যায় নূরী। বাবা শব্দটা সে শেখাতে চায়না। বাবা শব্দটার উপর দারুণ ক্ষোভ আর অভিমান ওর। ছোটবেলায় নূরীর বাবা ওর মাকে তালাক দিয়েছিল। তখন নূরীর বয়স ৪/৫ হবে। আজ পরীর বয়স এক বছর হল। মাঘ মাসের ২৪ তারিখ জন্মেছিল পরী। ক্ষুধায়, ঠাণ্ডায় আর ব্যাথায় কাহিল ছিল নূরী সেদিন। সারা রাতের প্রচণ্ড চেষ্টায় সকাল বেলা জন্ম দিয়েছিল পরীকে। প্রবল আবেগ জড়িয়ে ধরে পরীকে।

উঠোনে কার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঐতো শকুনেরা ফিরেছে। আদম সুরৎ, বাহার আলী, নিজাম উদ্দিন আর বাকীউল্লাহ। ছুরৎ আর ওর ঢাকাইয়া দোস্ত। যাদের কাছে টাকা ধার করে হাউজি খেলেছে ছুরৎ। আর ধারের বদলে নূরীকে..। দুচোখে পানি জমে, দু'গাল বেয়ে টপটপ গড়িয়ে পরে পরীর মুখের উপর। একদিন ঢাকাকে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছিল নূরী। আজ ঢাকা উঠে এসেছে ওর চালার উপর। নূরীর মায়ের মৃত্যুর খবর শুনেই এসেছে পিশাচটা, ওর সাঙ্গ পাঙ্গসহ। সাপের গায়ের মত চিকন ঠাণ্ডা ব্যথা ক্ষোভ দানা বাঁধে নূরীর মনে, আর অশ্রু হয়ে গড়িয়ে যায়। হয় মরে যাও নয়ত কাঁদতে থাক। এছাড়া কিছু করার নাই নূরীর। ‍‍‍‍‍‍‍কাকো কিছু কয়া দিলে, পরীক শেষ করি দেইম। ছুরতের এ কথাটা নূরীর মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছে। পরীর বুকে থুথু ছিটায় নূরী। জোড় করে অমঙ্গলের ছায়াটাকে সরাতে চায়। ছুরৎ নূরীকে ডাকছে। নূরী শোন, খেইজরের অস অাননু। মোর দোস্তর ঘরক ক্ষীর আন্দি খোয়াও ক্যানে। কি স্বাভাবিক সে স্বর। মনে হয় কত সুখের ঘরকণ্যা করে ছুরৎ আলী। বন্ধুদের জন্যে ক্ষীর! আচ্ছা ক্ষীরের সাথে যদি বিষগুলো মিশি দেওয়া যায়। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় নূরী। শকুনের চারজোড়া চোখ ছিড়ে-ছিড়ে খায় এর বাড়ন্ত যৌবন। দুটো গোবরের শলায় আগুন দিয়ে রসটা চুলায় চাপায়। তারপর আলুক্ষেতের আলপথ ধরে। যাতে কেউ সন্দেহ না করে তাই শাকের ঝাকাটা নেয়।

কয়মুঠি আলুশাকের নিচে জড়ো করা বিষের বোতলটা লুকিয়ে আনে। কোচরে লুকিয়ে রেখে হাড়ির রসে চাল মেলায়, প্যাকেটের দুধ মেলায়, বিষ.. না বিষটা মেলাতে পারেনা। মানুষ মারি জেল ফাঁসি হইলে পরীর কি হইবে? যদিও এদেরকে মানুষ বলে মনে করেনা নূরী। মানুষের রূপে শয়তান এরা। স্তুপীকৃত শুকনা পাতার নিচে ঢুকিয়ে দেয় বিষের বোতলটা। পায়েসের হাড়িটা দাওয়ার আনে স্টিলের প্লেটের ওপর সোনারোদ চমকায়। নূরীর মনে জ্বলে যন্ত্রণার আগুন। মুড়ির সাথে ক্ষীর খেয়ে বেড়িয়ে যায় ওরা। বলে যায় দুপুরে আসবেনা। নূরী দাওয়ায় বসে ভাবতে থাকে। ভাবনা মানেই কাঁদা। সৃষ্টিকতাকে বলে, উয়ার (ছুরতের) মরণ নাহয় ক্যানে? ভাবতে ভাবতে একটু চোখ ধরছিল। সিদ্দিক বাড়ির বড় মেয়ে সিরাতের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে ওর। ধরফর করে উঠে বসে। পরী বিছানা ভিজিয়েছে। সিরাত ঢাকা থেকে নিয়ে আসা জিনিসগুলো দেখতে এসেছে।

ছুরৎ এ গ্রামের সবার কাছে গল্প করেছে যে এবার থেকে যাবে। তাই সব কিছু নিয়ে এসেছে। আসলেই অনেক কিছু এনেছে ছুরত। একটা কালোসাদা ডোরাকাটা ব্যাগে একটা লাল ডুড়ে শাড়ি, ছায়া, আলতা, সুরমা, ভ্যালভ্যাটের ব্লাউজ, চকচকে লাল একজোড়া হাইহিল জুতা। যা এখনও ছুঁয়েও দেখেনি নূরী। সিরাত অনুমতির তোয়াক্কা না করেই ডোড়া ব্যাগটার জিপার খুলে সব বের করতে থাকে। জিনিসগুলো পড়তে চায় সিরাত। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় নূরী। ব্যাথায় টনটন করে মাথাটা। গলাটায়ও প্রচণ্ড ব্যাথা। রাতে টিপে ধরেছিল গলাটা। তারপর বন্ধুদের ডাকে বাইরে গেলে ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিয়েছিল ও। বেড়া কাটার হুমকি দিলে চিৎকার করার পাল্টা হুমকিতে কাজ হয়েছিল। রণে ভঙ্গ দিয়ে তারপর সারারাত তাস খেলেছিল ওরা দাওয়ায় বসে। বন্ধুদের শয্যা সঙ্গীনী করার জন্য নরমে নরমে অনেক চেষ্টা করেছে ছুরৎ। আজতো বেঁচেছো, কাল কি বাঁচবে? পরীকে কোলে তুলে একটু ক্ষীর খাওয়াতে শুরু করে নূরী। ততক্ষণে ফ্রকের উপরে শাড়িখানা জড়িয়ে হিলটা পায়ে দিয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে সিরাত। হঠাৎ মাকে দেখাবে বলে ছুটতে থাকে। নূরী চিৎকার করে বলে, “থামো বাহে মুইও তোমার বাড়ি যাইম।” বাচ্চাটার খাওয়া হলে কোলে তুলে দরজার শিকল তুলে দিয়ে সিদ্দিক বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। পথে ছুরতের সাথে দেখা হয়। ছুরৎ একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস কিন্তু শান্তিময় খবর দেয়। ছুরৎরা নাকি চলে যাচ্ছে। ছুরৎ আলী অভিমানের সাথে বলে, “মুইতো তোর সাথে থাকি যাবার জন্যে আসছিনু। মোর কথাতো শুনলুনা। ওমাক বিদায় করবার পারলে..। যাউক মোর কথাতো শুনলুনা এলা ঢাকা যায়া ওমারগুলার টাকাটা শোধ দেওয়া নাগবে। আইজ নাইট কোচোত ঢাকা যাম হামরা।”

আর সিদ্দিক বাড়ি যাওয়া হয়না নূরীর। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করে যে ওরা চলে যাচ্ছে। ভেবে ভাল লাগে। কিন্তু স্বস্তি পায় না। রাখালছেলেদের উড়িয়ে দেয়া একটা চংগুড্ডি ‘বো- বো’ শব্দ তুলেছে। শব্দটা নূরীর অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলছে। তবুও একটু মুক্তির স্বাদ অনুভব করতে চায়। ফিরে এসে ক্ষীর খাওয়া এঁটো বাসন তোলে। দাওয়ায় পাতা খড়ের বিছানাটা তোলে। পরীর ভেজানো কাঁথাগুলো নিয়ে তিস্তার শাখা খালটার দিকে যায়। পরীকে পাড়ে বসিয়ে রেখে কাপর কাচে, গোসল করে। বাড়ি ফিরে ব্যাথার যায়গাগুলোতে হেকমত আলীর ‘কাচি কাটা বাম’ লাগায়। দুটা মুড়ি খেয়ে একগ্লাস পানি যখন খায় তখন আসরের আজান দিয়েছে। ঘুড্ডিটার অস্বস্তিকর শব্দটা তখনও চলছে।

সন্ধ্যায় চলে যেতে চেয়েছে ওরা। আরও আগে বিদায় করতে পারলে খুশী হয় নূরী। তাই তাড়াতাড়ি চুলায় আগুন দিয়ে হাড়িটা চাপায়। চাল ধুয়ে দিয়ে ভাবতে থাকে কি রান্না করবে। এমন সময় হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে ফেরে ছুরৎ। গোশত, আলু, মরিচ, মশলা। আশুমুক্তির আনন্দে খুব তাড়াতাড়ি রান্না করে খাওয়ায় ওদের। তৃপ্তির ঢেকুর তোলে ওরা। সিদ্দিক বাড়িতে দীর্ঘদিন রান্নার কাজ করে নূরী। রান্নাটা ওখানেই শিখেছে ও। গোশতের হাড়িতে ভাত নিয়ে সে নিজেও খেতে বসে। পারে না। মুরগীর খোয়ারে হাড়িটা ঢুকিয়ে দেয়। রান্নার হাড়িকুড়ি গুছিয়ে পরীর জন্য বার্লিটা গরম করে খাওয়াতে এসে দেখে সিরাতের এলোমেলো করে যাওয়া কাপড় চোপড় গুলো গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে ছুরৎ। তারপর কালী সন্ধ্যার অন্ধকারে অদৃশ্য হয় চারজন। কিন্তু স্বস্তি পায়না নূরী। একটা অজানা ভয়, অজানা আতঙ্ক, একটা আশংকার ঘন কুয়াশা ঘিরে থাকে নুরীর হৃদয়কে। বাইরেও খুব ঘন কুয়াশা পড়েছে। কুয়াশার চাদরে আঁধারে কারুকাজ। বাতাসের ফিসফিসানিকে পিশাচের নিঃশ্বাসের মত মনে হচ্ছে। আজকে ঘুমাতে চায়না নূরী। কেরোসিনের বাতিটা তুলে দেখে নেয়, দরজার খিলটা দেয়া হয়েছে কিনা। একটা বাঁশের টুকরা দিয়ে ঠেকা দেয় দরজাটা। বাতিটার উজ্জলতা বাড়িয়ে দিয়ে পরীর পাশে বসে নূরী। না আজ ঘুমাবেনা নূরী। মনটা কেমন যেন খচখচ করছে। মার কথা খুব মনে পরছে নূরীর। মা না থাকাতে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। কত রাত দু’মায়ে মেয়েতে কত গল্প করেছে। পরীকে নিয়ে নূরী কত উড়িয়েছে স্বপ্নের রঙ্গিন ঘুড়ি। সে সব স্বপ্ন কি পুরণ হবে? ভাবতে ভাবতে দুচোখের পাতা ভারী হয়ে উঠে। ঘুম ঘুম পায়। নড়েচড়ে বসে নূরী কিন্তু পারেনা। ক্লান্ত, অবসন্ন, ক্ষুধা ক্লিষ্ট, ভাগ্যতাড়িত অবসন্ন নুরী একটু পরেই ঘুমিয়ে পরে।

ঘুমিয়ে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখে ও। সুন্দর চনমনে রৌদ্রজ্জ্বল দিন। সিদ্দিক কাকার বাড়িতে কাজে যোগ দিয়েছে নূরী। পরী সিরাতের ছোটবোন সিয়ামের সাথে ধাপগাছ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। স্কুলে নতুন আপা বটগাছটার নিচে ওদের পড়াচ্ছে স্বর.. অ.. স্বর.. আ। একি আপা কোথায়? এযে পরী! দিনের বেলা যে গুড্ডিটার শব্দে কাতর ছিল নূরী সেই গুড্ডিটাই কোথা থেকে এসে পরীকে তুলে নিয়ে হাসতে হাসতে ভাসতে থাকল। নূরীও হাসে। হঠাৎ তিস্তার আউলা বাতাসে পাক খায় গুড্ডিটা। পরে যাচ্ছে পরী। পরী..ই..ই। চিঃকার করে ডাকতে চায় পরীকে। পারেনা। দু’হাত বাড়িয়ে ধরতে চায় মেয়েকে। পারেনা। অসীম শূন্যতা চারদিকে। শূন্যতা গ্রাস করে নূরীর হৃদয়, মাঘের কুয়াশা ঘেরা গমের ক্ষেত, বিস্তীর্ণ আলুর ক্ষেত, তিস্তার শাখা খালটার তীর ঘেষে কচিঘাসের পতিত জমিগুলো ছুয়ে শূন্যতাটা বিস্তৃত হল অনেক দূর।

অতঃপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিশির শিক্ত গমের কচি থোরের বিছানায় ব্যবচ্ছেদ হল নূরীর অহংকার, সম্ভ্রম, স্বপ্ন। একটুও লাগেনি নূরীর শরীরে। চোখের সামনে সুতা ছেড়া চংঘুড্ডিটা প্রচণ্ড বেগে পাক খেতে খেতে ঘুরতে থাকে। ঘুরতে থাকে পরী। তখনও দুহাত বাড়িয়ে মেয়েকে ধরতে চায়। পারেনা। দুটো কঠিন হাত নূরীর দুর্বল হাত দুটোকে গমের ক্ষেতের সাথে ঠেসে ধরে থাকে। হঠাৎ ঘুড়িটা আর দেখতে পায়না ও। একটা কঠিন লোমশ হাত চেপে বসে যায় ওর কণ্ঠনালীতে। ধাপগাছের বাতাস কত মধুর এই প্রথম ও শেষবারের মতো বুঝতে পারে নূর-ই-জান্নাতি।

তারপর শাখা খালটার বালুচরের ওপর হতে অন্ধকার মিলিয়ে যাবার আগেই ওর বুকে ঠাঁই পেল নূরী- একতাল মাংস পিণ্ড। সাথে একটা ডোড়া কাটা কাপড়ের ব্যাগ। যাতে ছিল লাল ডুরে শাড়ি, ভেলভেটের লাল ব্লাউজ, আলতা, সুরমা, একজোড়া লাল হাইহিল। অবশ্য ছুরতের জুতাজোড়াও রয়ে গেল ওর সাথে।

সকালের সূর্যটা আলো ছড়াতে শুরু না করতেই প্রতিবেশীরা জড়ো হয়ে এক কাহিনী আবিষ্কার করল। যার সারমর্ম নূরী ছুরতের দোস্তদের সাথে পালিয়েছে। দাওয়ার এককোণে ছুরতের কোলে অবিরত কাঁদছিল পরী। ছুরতের চোখ ফোলা, মাথাটা ছিল মাটির দিকে। সমবেতদের মধ্যে পরীর জন্যে মমতা উঠল। পরীর দেখাশুনার জন্যেই যে ছুরতের একটা বিয়া করা প্রয়োজন তাও জানাল সবাই। এমনকি ধাপগাছ-রতনপুর-নয়ার বাজারের যত সোমত্ত মেয়ে আছে সবার সাথে জোড়া মেলানোও শুরু হয়ে গেল। এক ফাঁকে সিরাত এসে পরীকে এসে নিয়ে গেল ওদের বাড়ি। পরিচিত পরিবেশ আর সিয়ামকে পেয়ে পরী একটু শান্ত হয়ে খুঁজতে শুরু করল ও। মাকে কোনদিন পাবে না তাতো জানেনা কচি মেয়েটা।

অতঃপর নূরী নামের এক ডাইনীর অবৈধ প্রেম ও পলায়ন কাহিনী পত্র-পল্লবে-শাখায় বিকশিত হল। বিশাল এক ধাপগাছ হয়ে ধাপগাছ-রতনপুর-পাওটানার মাঠে, ঘাঠে, বাজারে, মসজিদে, স্কুলে, মাদ্রাসায়, মেয়েদের অলস আড্ডায় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল। আলোচনার মন্তব্যে অবশেষে নূরীর আশ্রয় হল দোজখতুল্য নিষিদ্ধ পল্লীর কোন ঘরে। ছুরৎ ছাড়া ধাপগাছের আর কেউ জানলোনা বাড়ি থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে, একটা বস্তায় বড়-কষ্টে আছে নূরী। মাথার উপর বিস্তীর্ণ আকাশ, বুকে বিস্তৃত বালুরাশি। সে বালুর উপর খেলা করে আগুন সূর্য। রাতে গোড় খোদকেরা হেটে বেড়ায় নূরীর মাথার ওপর দিয়ে।

পরীর কি হল? সে গল্প অন্যদিন। তবে বাবা নামের মানেটা ওর কাছে অন্যরকম ছিল। আর রাতজাগা পাখির মত রাতটা জীবন্ত হয়ে দিনগুলো ছুটি নিয়েছিল পরীর জীবন হতে।
প্রক্ষেপণ | সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক

প্রক্ষেপণ | সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক

প্রক্ষেপণ | সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক
০১. অতঃপর ইন্দ্রানী আত্মহত্যার শেষ সিদ্ধান্ত থেকে আবারও চ্যুত হলো। অবশ্য এবারের ওর সিদ্ধান্ত চ্যুতির পরিকল্পনা অকারণ অন্তরঙ্গতা-আকীর্ণ উপলব্ধির কারণটিও একটু ভিন্ন ঢংয়ের। কবে কোথাকার কোন এক অসভ্য নাগরিক-অসভ্যতার নর্দমার কর্দমাক্ত জীবাণুর মতো উৎসহীন ঈশান নুর কোথায় বলেছিল-‘ইন্দ্রানীরে গাঙের পানিও সব শুকায়ে গেল, তুইও কমিউনিস্টো হইয়ে গেলি। ওদিকে সবাই যে খালি চাটতিছে। তবুও পুরোটাই কম্যুনিস্টের স্যাতস্যাতি ধ্বজা উড়োয়ে দিলি’ নবদ্বীপ হাটের নতুন রাজাকার চেয়ারম্যান ঈশান নুরের ব্যাঙ্গ মিশ্রিত তিরস্কার।

সহ্য করতে পারেনি ইন্দ্রানী। মুহূর্ত কয়েক বিব্রত বোধ করেছিল মাত্র। সামান্য এক চিলতে কপালে দু’তিনটে অসামান্য রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল দ্রুত। কপালের সাথে যোগাযোগ করে চোখ দুটিও যেন ছোট হয়ে এসেছিল স্বাভাবিকভাবেই। শুধু তারা দুটি যেন হঠাৎ করেই দপ করে জ্বলে উঠে আবার নিভে গিয়েছিল রাতে ব্যবহার করা অত্যাধুনিক ক্যামেরার তীব্রভাবে জ্বলে ওঠা ফ্ল্যাশ বাল্বের সিলভার-কালার বৈদ্যুতিক আলোর ঝিলিকের মতো। ঠাস করে একটা শব্দ ম্লান অন্ধকারকে সঙ্গে সঙ্গেই দুর্বোধ্যভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছিল যেন। হাতটা দ্রুতই এসে পড়েছিল ঈশান নুরের গালে। একেবারে তামাটে হয়ে যাওয়া কুচকুচে কালচে গালের উপর। ঈশান নুর চমকে ওঠে নি। আশ্চর্যও হয় নি- দেখছিল শুধু ইন্দ্রানীকে। অপলক দৃষ্টিতে নয়- পিট পিট করে। জিহ্বাটা বেরিয়ে এসেছিল ঠোঁটদুটিকে ভিজিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু ঠোঁট দুটিকে ভেজাতে পারে নি। শুকনোই থেকে গিয়েছিল।

আর দাঁড়ায় নি ইন্দ্রানী। সোজা চলে এসেছিল নিজের ঘরে। ঘরে ঢুকেই টনটনে এক যন্ত্রণার মতো শুকনো বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরী ভাঙ্গাচোড়া টং জাতীয় একটি বস্তুর উপর শত ছিন্ন কাঁথা দিয়ে মোড়ানো বিছানা নামের অসহ্য একটি অত্যাচারের কাছে অবলীলায় সমর্পণ করেছিল নিজেকে প্রচণ্ড একটি উত্তেজনার আকর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্যই বোধ করি। এপাশ ওপাশ করছিল কয়েকবার। তারপর একেবারে শ্রাবণের সাথে একাকার। হয়তোবা বোধগম্যতার বাইরে এক ধরনের অর্থহীন ব্যর্থ অভিসারের ফলাফলের মতো। অবশেষে অনেকক্ষণ ধরেই নীরবে কেঁদেছিল ইন্দ্রানী। পাশ ফিরে সোজা চিত হয়ে চোখের দৃষ্টি বিস্তৃত করে দিয়েছিল হোগলার চালার অসংখ্য ফুটোয়। আটকে গিয়েছিল সে ফুটো গুলিতে টুকরে, টুকরো খণ্ড, খণ্ড অসংখ্য  ঈশান নুরের বিবর্ণ মুখ। চোখ দুটোকে ঝাপসা করে তুলেছিল। ইন্দ্রানীর অসংখ্য বুকচেরা আকুলি বিকুলি বার বার ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল আবার ইন্দ্রানীর কাছেই ঐ টুকরোগুলোর সাথে সাথে। শেষ উত্তর যা পেয়েছিল তাতে অবশিষ্ট আর কিছুই ছিল না। সব শূন্য হয়ে গিয়েছিল। কেমন যেন একটা অবজ্ঞার চাকচিক্য ঝলসে উঠেছিল উত্তরের সবটা জুড়ে। ‘ইন্দ্রানীরে মিলিটেরিরা আমার চোখের পর্দা খুইলে দেয়ে গেছে। রাজাকারের রাইফেলটাই আমারে নবদ্বীপের হাটের চিয়েরম্যান কইরে দিতি পেরেছে। কিন্তু তুই যে একেবারে পুরোটাই কম্যুনিষ্টোর ক্ষ্যাত হইয়ে গেলি!’ একটি কুৎসিত তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠে ঈশান নুরের কন্ঠস্বরে।

‘কি কইলা? তালি আমারে কম্যুনিস্টোর ক্ষ্যাত বানাইলো কে? আর আমিই বা ক্ষ্যাত হইয়ে গেলাম ক্যান্। আমার উইদ্ধের?’- ইন্দ্রানী অসহায় আক্রোশে চিৎকার করে উঠতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই ঐ টুকরোগুলি চূর্ন বিচূর্ণ হয়ে চুইয়ে চুইয়ে নির্ঝরের মতো নেমে আসতে শুরু করেছিল ওর চোখের পাতায় অমৃতের নয় বিশুদ্ধ গরলের জোয়ারের মতো ইন্দ্রের আধ্যাত্মিক রাজনীতিকে সাথে নিয়ে। ইশান নুর যেন এ কথাকটিই বলতে চেয়েছিল ‘সোমাজতন্ত্রে ঈশ্বর নেই। ঈশ্বরে নিজেরে সমর্পণ কর, উইদ্ধের তিনিই কইরবেন।’ বুঝতে পেরেছিল ইন্দ্রানী। শেষে এক সময় নিজেই থামিয়ে দিয়েছিল নিজের সে কান্নাকে। উঠে বসেছিল বিছানার ওপর। স্বাধীনতার বুকভরা নিঃশ্বাসের মতো দৃষ্টিকে সীমার বাইরে ছড়িয়ে দিয়ে উচ্চারণ করেছিল মাত্র দুটি শব্দ। জিভের লালা দিয়ে ভরে যাওয়া চকচকে পুরুষ্ঠ ঠোঁট দুটির ফাঁক  দিয়ে ঝিকঝিকে সাদা দাঁতের ডগা ছুঁয়ে বেরিয়ে এসেছিল ‘আত্মহইত্যে- আর না।’

বেরিয়ে পড়েছিল ইন্দ্রানী ঘর ছেড়ে। একটা দারুণ ক্রোধের সাথে রক্তারক্তি কিছু অভিমানের বেদনাকে মিশিয়ে দিয়ে একটা বিশাল অহংকারের সাথে প্রতারক কিছু অমর্যাদার তীব্রতাকে জড়িয়ে নিয়ে ওর নিজের মানুষ ইন্দ্রের খোঁজে। অনেক আগে থেকেই খুঁজে চলেছে ইন্দ্রানী ওর ইন্দ্রকে ওর অবসেশনের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু সেখানে কখনই খুঁজে পায় নি ঈশান নুরকে। আর দ্রুত গতিতে অপসৃয়মান কালকে যেন মনে হয়েছে আসলেই কালের উর্ধ্বে নিজের স্থান করে নিতে কিছু গাঢ় দ্বিধাহীনতায় ভুগে চলেছে সে। রেখে যাচ্ছে শুধুু দগদগে আর কিছু অসম্ভব গাঢ় ক্ষত চিহ্ন ইন্দ্রানীর সারা শরীরের আনাচে কানাচে। ক্লান্ত রক্তের কোষে কোষে টকটকে তাজা টসটসে ইন্দ্রানী হয়ে উঠেছিল রোদে দেবার আগে চিপে নেয়াা ভিজে কাপড়ের মতো। ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার শক্তিও যার ছিল না। অথচ সেই ইন্দ্রানী আজকে যেন বড় উদ্ধত, বড় বেশী ঋজু। সব খোঁজাখুঁজি শেষ হয়ে গেছে। অথচ এ মুহূর্তটিতেই ওর কেন যেন মনে হলো সে যেন খুঁজে পেয়েছে তার ইন্দ্রকে। দাঁড়িয়েছে একেবারে ইন্দ্রের মুখোমুখি। আজকে হলদে ভোরের রাত্রি থেকে ছিটকে বেড়িয়ে আসবার সামান্য কিছু মাত্র আগেই দাঁড়িয়েছে একেবারে ইন্দ্রের মুখোমুখি। প্রচণ্ড বেগে হেসে উঠতে চেয়েছিল ইন্দ্রানী। হেসেছিলও, কিন্তু শব্দের ক্ষীণতায় নিজেই কেঁপে কেঁপে উঠছিল ইন্দ্রানী বার বার- ভয় পেয়ে গিয়েছিল হয়তো বা শক্তির দীনতায় এ ক্রুদ্ধ হাসিটাই আবার কান্নার ভেতরে ডুবে যাবে মুহূর্তে। ভীষণ কষ্ট সহ্য করেও সংবরণ করে নিয়েছিল নিজেকে ইন্দ্রের সামনে। একেবারেই ওর চোখের তারায় রক্ত বর্ণ দুটি চোখে রেখে। কতকটা যেন অতি ঘোর অনিবার্য এক বিধ্বংসী দুঃসাহসে ভর করে। স্বপ্নটা দপ করে জ্বলে উঠেই আবার নিভে গিয়েছিল মুহূর্তে।

০২.                                                               
‘অই ছেনাল মাগী।  ঘুম যে ভাংতিছেনা বড়। রেতের বেলা কি গতরটারে মেইলে ধইরে সইন্যেসীগের শুইবের আসন পেইতে গিয়েছিলি? নাকি ঢলো ঢলো অঙ্গের উপর দে  আবার ব্যাধের কাফেলা পার হইয়ে গেছে ? ও-তো আবার তোর মইধ্য রেতের শাক ভাত।’ - দুর্গাদাসের গলা। কিছুুটা জড়ানো হলেও বড় খট্ খটে আর নির্মম। কথাগুলো কানে গিয়েছিল ইন্দ্রানীর। ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল অনেক আগেই কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করেনি। একটি তন্দ্রার মতো নরম আচ্ছন্নতা যেন জড়িয়ে রেখেছিল ওকে কেমন একটি মসৃণ পেলবতা দিয়ে। বড় দুর্বল হয়ে পড়েছিল ইন্দ্রানী। আর ওর সেই দুর্বলতার ভেতর দিয়ে কেমন যেন এক অদ্ভুত ধৃষ্টতার ছায়াও পড়েছিল ওর সব আচ্ছন্নতাকে ডিঙ্গিয়ে হৃৎপিণ্ডের রক্ত কণিকায়। নিসপিস করছিল প্রতিটি আঙ্গুলের ডগা। তীক্ষ্ণ নখের তীব্র আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছিল ইন্দ্রানী নিজেকে। রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল ইন্দ্রানীর হৃৎপিণ্ড থেকে।

ক্ষরিত সে রক্ত ধারার স্রোতে আবার লক্ষ করছিল ইন্দ্রানী কঠিন মাটির গভীরতাকেও দীর্ণ করে লকলকে একটা আগুনের মিহি শিখা যেন বেড়িয়ে আসছে অসম্ভব দ্রুত গতিতে ইন্দ্রানীকে সংহার করবার জন্যেই সম্ভবত। ভয়ে কুঞ্চিত হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রানী। সেটে গিয়েছিল গায়ে লবন দেয়া কেচোর মতো। মুখটা আপনা আপনি বেঁকে গিয়েছিল ইন্দ্রানীর। রক্তশূন্য রোগীর সাদা চোয়ালের মতো হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রানীর ভরপুর চোখমুখের অবিলোল লাবণ্য। চিৎকার করে উঠে নি ইন্দ্রানী। শুধু গলে গিয়ে দলা পাকানো মোমের মতো কুকরে গিয়েছিল মাত্র। ইন্দ্রানীর ধারণা হয়তো আত্মসংহারই ছিল ইন্দ্রানীর অনিশ্চিত আর অস্বচ্ছ ভবিষ্যতের জন্য মোক্ষম প্রয়োজনীয়। অথচ প্রয়োজন বোধ করেও সে প্রয়োজনের মূল্য দেয় নি ইন্দ্রানী। কাকে যেন পাবার এক প্রবল আকাঙ্ক্ষায় বিচলিত আর সম্মোহিত করে ফেলেছিল ইন্দ্রানীকে। কিন্তু কে সে? সেই কি ঈশান নুর?  ইন্দ্রানীর প্রথম প্রেম। ইন্দ্রানীর ইন্দ্র।

‘কইরে ইন্দ্রানী। কানের পর্দার ফুকরো দোরে কি ফাটকের তালা মেইয়ে দিইছিস। সোহাগের ডালাটা ইট্ট খুইলে ধরে উইদ্ধার কইরে দে দয়া কইরে আমারে।’ দুর্গাদাসের বিশ্রী তিরস্কার। ‘সোহাগের ডালার মুখ খুইলে দিয়েছি বইলেই না কাত্তিকের হিজরে কুইত্তের মতো ঝুইলে পড়া জিভ টান কইরে নালা নর্দমা, খানা ডোবা সব একাকার কইরে শুইকে বেড়াতিছো। নিজের মাগরে সুখ দেবার মুরোদ নেই তার আবার কস্তুরির সুবাস নেবার মাতামাতি। আমি রইয়েছি বইলেই তো সাড়ে তিন পহর পার না হতিই ন’কোশ, ছ’কোশ কইরতি পারতিছো । শরম মরদের বালাই, চণ্ডালের পাপ আর শুদ্রের জ্বালা।’  কথাগুলি বলে হাঁপাতে থাকল ইন্দ্রানী। একটা বেগবান জীবনের নিরন্তর প্রবাহ যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। সিদ্ধান্ত গ্রহণের শিথিল উপলব্ধিটা তরাণ্বিত হয়ে ঘণিভূত হতে থাকলো। উঠে দঁড়ালো ইন্দ্রানী। ক্ষণ কয়েক কি যেন ভেবে নিল। এদিক ওদিক দেখলো কিছুক্ষণ। আর সময় নেই ইন্দ্রানীর। এবার ছুুটতে হবে বুঝতে পারলো ইন্দ্রানী। আর এবারের এ ছুটে চলা হবে বিরামহীন, যতিহীন এবং অবিশ্রান্ত।

ইন্দ্রানী। বুকের ভেতর বাতাসের বান ডাকলো। ভাতের শূন্য থালায় আরশোলা তাড়ালো ডান হাতের তর্জনী দিয়ে। বালিশের উপরে টিকটিকি দেখেও দেখলো না ইচ্ছে করে। পা বাড়ালো জীবনের প্রথম সংসার নামের যুথবদ্ধ পিচপিচে কালাজ্বরের চৌহদ্দির বাইরে। ঘৃণায় ছোট্ট কপালের ঠিক কেন্দ্রে একটা চিহ্নের উদ্ভব হলো। সিদ্ধান্ত ঘন দুধের ঘনত্বের চাইতেও দৃঢ় হলো। বুঝতে পারলো ইন্দ্রানী সময় ফুরিয়ে গেছে। আর এখানে নয়। যে সিদ্ধান্তটি সে বাতিল করেছিল সে সিদ্ধান্তেই আবার ফিরে যেতে চাইলো ইন্দ্রানী। আত্মহত্যার সিদ্ধান্তটিই এই মুহূর্তে বড় কাছের মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেল। বড় আপনার হয়ে গেলো ওর। বড় উপযোগী মনে হল আত্মহত্যাটিকে। দৃষ্টি অসীমে অদৃশ্য হলো।
চন্দ্রদীপ আর কত দূর? যাবার সময় শুধু বলে গেল ‘তোমার সোংসারের কপালে আগুন। ঈশ্বর আমার মাতাই থাইক।’

দূর্গাদাস ইষৎ হাসলো। কোন প্রতিক্রিয়া হলো না দুর্গাদাসের ভেতরে অথবা বাইরে। ইন্দ্রানী নিজেও বুঝতে চাইলো না তার পুরোটা। শুধু বুঝলো ঐ হাসিটি বড় অবজ্ঞার, বড় ঘৃণার এবং আরোও বড় আত্মদম্ভের বুঝিবা। লক্ষ্য করল ঐ হাসিটির উপরেই মুদ্রিত একটি তিরস্কারের ঈঙ্গিতকেও।
‘যেতিছ যাও। তবে মইরবের আগে এই দুর্গাদাস পাড়ই অমৃতের সমান।’

ঘর ভেঙ্গে গেল দুর্গাদাসের। চলে গেল ইন্দ্রানী। দুর্গাদাসও আর মনে করলো না ইন্দ্রানীর মতো নিছক একটা নারকী পাপাত্মার জন্যে তিল মাত্র কালক্ষেপণের মধ্যে কিছুমাত্র যথার্থতা অথবা পুরুষতা আছে। প্রতিদিনের অভ্যেস আর নৈমিত্তিক নিয়মের সূত্র ধরে জুতো, চটি মেরামতের যন্ত্রপাতি, সরঞ্জামাদি ইত্যাদির বেঢপ দড়ি বাঁধা কাঠের বাক্সটিকে বাঁ কাঁধের উপর ফেলে দু’ঠোটের আঠালো কোনায় ছোট্ট একটা আধ পোড়া বিড়ির চুপসে যাওয়া পুরো গোড়াটিকে ঠেলে দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো দুর্গাদাস নবদ্বীপ হাটের পথে। খালি পা, ধুতির প্রান্তটি হাটু অবধি ওঠানো, উদোম গা।

এই নবদ্বীপ হাটেই প্রথম পরিচয় ইন্দ্রানীর সাথে দুর্গাদাসের। এবং শুধু পরিচয়ই নয়, সাথে সাথে পরিচয় থেকে সরাসরি একেবারে ঘরে তোলা পর্যন্ত। পরিচয়ের ঘটনাটি অবশ্য ঘটে যায় কোন এক ভিনদেশী গৃহত্যাগী সমর্থ যোগী অমৃতলাল ব্রহ্মচারীর সৌজন্যে কিছুটা আকস্মিকভাবেই। এবং তার চাইতে বেশী আকস্মিকভাবেই নির্দেশটিও আসে যোগীর কাছ থেকেই ইন্দ্রানীকে সরাসরি দুর্গাদাসের ঘরে তুলবার। দুর্গাদাসের ভাববার আর কিছু ছিল না। ঈশ্বরাশির্বাদ ভেবে ঢিপ করে যোগীর দুটো পায়ের লম্বা পাতায় আরো লম্বা একটা প্রণাম ঠেকিয়ে ওরই সামনে ওরই উচ্চারিত মন্ত্রের শুদ্ধাশুদ্ধ অনুকরণ করে ইন্দ্রানীকে তুলে নিয়ে গেল দুর্গাদাস ওর হোগলায় ঢাকা ভাংচুর শোবার ঘরের নোংরা কাথার চাইতেও ভাংচুর বিছানার মাঝখানে। যোগীরও দৃশ্যান্তর ঘটে গেল এরপর। যাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি কখনোই, কোনদিনই। এই যোগী অমৃত লাল ব্রহ্মচারীই নষ্ট করেছিল ইন্দ্রানীকে। যোগী ‘তন্ত্র বলে’- ঈশান নুরকে পাইয়ে দেবে এ আশ্বাসকে বিশ্বেস করেই নিজের দেহ ভাণ্ডটিকে অকাতরে উপায়হীনভাবে মেলে ধরেছিল ইন্দ্রানী যোগীর লোভের আগুনে পুড়ে ছোট হয়ে যাওয়া লাল টকটকে চোখ দুটির সামনে।

‘বুঝলি ইন্দ্রানী’। কিছুটা সাহসে ভর করে এগুবার চেষ্টা করে দুর্গাদাস। ‘তোরে আমি জানতেম, মিছে বইলে আর পাতকি হবার ইচ্ছেও নেই এই বয়েসে আমার। মাঝে মাঝে হোগলার ফুক্রো ফাঁক দে তোরে আমি দেখতেমও। কিন্তু তোরে কিছু বইলবের সাহসটিই আমার হতো নে।’ আর কিছু বলে না দুর্গাদাস। ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে একটি বিড়ি ধরায়।

চুপ করে থাকে ইন্দ্রানী। শুধু চোখের কোলে একটা নেতানো মেয়ে মানুষী ঋতুকালীন সংকীর্ণতায় ঠোঁট দুটি কাঁপতে থাকে, চোখের কোল দুটি চিক্ চিক্ করে ওঠে বুঝিবা। পরমুহূর্তেই ভিজে যায় গাল দুটি। ইন্দ্রানী ভাবতে থাকে অতীত। কিন্তু সে ভাবনা ছাপিয়ে হঠাৎ করেই যেন চলে আসে একেবারে এই মাত্র বাসি হওয়া নতুন স্মৃতির প্রথম পৃষ্ঠায় । নববধূ ইন্দ্রানী। জীবনের প্রথম বিয়ের সলজ্জ কনে। এ সময় ঝগড়া ঝাটি নাকি বড় কুলক্ষণের। দুর্গাদাস কিন্তু থামে না। ইন্দ্রানীর নীরবতায় আরো বেশি করে সাহসী হয়ে ওঠে। অনর্গল অর্গল ভেঙ্গে কথার ইন্দ্রজাল রচনা করে-

‘তা একদিক দিয়ে আমার জইন্যে শুভই হইয়েছে বলতে হবি। ইন্দ্রের জন্যে ইন্দ্র ইন্দ্র বইলে বুক ফাটিয়ে সেই যুদ্ধের ঘোর তা-বের মইধ্যেই একবার মিলিটারি ক্যাম্পে ঢুকতে পারলিই তো আর আইজকের এই বহু কর্ষণে চিড় ধরা জীর্ণ বস্ত্রের মতো দিশী সোমাজতন্ত্রের ক্ষ্যাত হয়ে ফিরতি পারতিসনে। মিলেটেরিরাই তোরে উইদ্ধের কইরে দিতো। সাথে সাথে আমার ইচ্ছের ডগাটিও আর চাক্ষুস তুই পর্যন্ত ঠেকতি পারতো নে।’ একটু থেমে আবার শুরু করে ‘ঈশ্বর মঙ্গলময়, শুন্য কানে আর আঙ্গুল ঠেলতে হবি নে। সাক্ষাত ভগবান নিজেই দূত হইয়ে নিজের হাতে ধইরে এনে সইন্যেসী বাবারে দিয়ে তথাস্তু কইরে তোরে একেবারে আমার কোলের উপ্রে তুইলে দিয়ে গেলেন। নাইলে কোথায় কখন কে শুইনেছে - ডোমের ঘরে কুলিনের ফুল শইয্যে!’

এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে একটু জিরোতে চাইলো দুর্গাদাস। এমনিতেই গঞ্জিকাসেবী তার উপর আবার সুখাদ্যের অভাব। সেই সাথে মাঝে মধ্যেই উপোষের জ্বালা। তার সঙ্গে আবার চিরায়ত দৈহিক উত্তেজনার পীড়ন, অনাচারের মতো প্রাত্যাহিক ব্যাপারগুলি ছায়ার মতো লেগে  থাকা আদিকালের অভ্যেস। রেগে উঠে ইন্দ্রানী ভেতরে ভেতরে অতিমাত্রায়। রক্ত বর্ণে সমস্ত মুখম-ল লালচে হয়ে যায় এবং আরো গভীরতর হতে থাকে। ইন্দ্রানী বোঝে না সমাজতন্ত্র কী? অথচ ঐ একটি মাত্র শব্দতেই বড় ক্ষোভ, বড় ঘৃণা আর অসম্ভব আক্রোশ ইন্দ্রানীর। সাথে আরো বড়ো মাত্রার মিশ্রিত অভিমান। কিছুতেই সহ্য করতে পারে না ইন্দ্রানী। ঐ একটি মাত্র শব্দ ‘সমাজতন্ত্র’। কোন কারণে কেউ কোথাও সে কথা উচ্চারণ করলে আর তা ইন্দ্রানীর শ্রবণ পর্যন্ত কোনক্রমে পৌঁছে গেলে বড় কষ্ট হয় ইন্দ্রানীর। বালির সৌধের মতো বর্তমানটি ওর দরদর করে ভেঙ্গে পড়ে ওর চোখের সামনেই। বড় কাছাকাছি চলে আসে ইন্দ্র, ইন্দ্রের ঘনিষ্ঠ চিনে চিনে উপলব্ধি।

আর সন্ন্যাসী বাবা। গৃহত্যাগী যোগী অমৃতলাল ব্রহ্মচারী। সে তো এক মহাঘোর কৃষ্ণপক্ষের থমথমে মধ্যযামের রতিক্রান্ত অশ্বযুথ। কদাচিৎ আবার যৌগিক প্রতিক্রিয়ায় ঘটে যাওয়া সমুদ্র তলদেশের উত্তাল তা-বের মতো যে তাণ্ডবের বিকীর্ণমান অগ্ন্যুৎপাত আবার শেষ পর্যন্ত প্রশান্ত জলধির উপরিস্তর থেকে স্বভাবতই দৃশ্যমান হয় না জলের প্রতিভায়।
‘মিলিটেরি! ওরে জলধর, ইন্দ্ররে ধইরে নিয়ে নে গেল’। নবদ্বীপ হাট উল্টে দিয়ে লুঙ্গির কাছায় কোমর বেঁধে উঠি পড়ি দৌড় ভেঙ্গে চিৎকার করতে থাকে ইয়াকুব। ওকে অনুসরণ করে জলধর।

‘ওতো ধইরবেই। রাভরা প্যাটে নকল উপোসের ঢংয়ে সোমাজতন্ত্রের ঢ্যঁড়া পিটোলি রাইজ্যের রাজা কি আর ঠিক থাকতি পারে। ইট্টু, আধটু গৌরচন্দ্রিকা তো থাইকবেই। সোমাজতন্ত্র!’ ইয়াকুবের কথার উপর ঘৃণার থু-থু ছিটোয় জলধর। চোখ বুজতেই শশ্মানের নিদারুণ নিস্তব্ধ নিঝুম নবদ্বীপ হাটের হাহাকার। জলাঙ্গী তীরের জীবন জোয়ারও তখন সে হা-হাকারে উল্টে যায়। বাবাও আর দৃশ্য অদৃশ্যের দোলাচলে স্থির অনিশ্চিত ঈশ্বরে ভরসা খুঁজবার মতো সঙ্গত কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না। জাগতিক লোটা কম্বলের প্রয়োজনই প্রত্যক্ষ বাস্তবতা। টোল খেতে খেতে বাবাই সামলে নিলেন ইন্দ্রানীকে। প্রায় মূর্ছা যাবার মতো অবস্থা। এই ‘বাবা’- নামের বস্তুটি হলো সেই যোগী অমৃতলাল ব্রহ্মচারী। প্রায় মুর্ছা যাওয়া ইন্দ্রানীর শরীরি উত্তাপ যেন তার সব যোগীত্বকে নিঃশেষ করে দিলো। পরিবর্তিত করে দিলো এক উচ্চকামী লোভাতুর হিংস্র পাপাত্মায় । নিজেকে উপলব্ধি করবার মতো করে উপলব্ধি করতে চাইলে ইন্দ্রানীকেও। এভাবে হরিদ্রা-বর্ণের এই সুবর্ণ মেখলা যে বড় পিপাসার্ত। ওকে জল পান করানো ব্রহ্মচারীর অবশ্য পলনীয় কর্তব্য। নিজে নিজে আপনা আপনিই বুঝে ফেললেন বাবা। পিপাসার্ত অঙ্গের তৃষ্ণা আত্মাকে যে বড় বিচলিত করে। বড় কষ্ট দেয়। চিন্তান্বিত হলেন বাবা। ঘোর কাটিয়ে অভিভূত। দূর লোকালয়ের ঘন বসতি ভাঙ্গা মরাকান্নার রিনরিনে জোরো প্রলাপ, গাছ গাছালির পত্র পল্লবে ভর করে ক্রমাগত আঁছড়ে পড়তে থাকলো সন্ন্যাসী বাবার শ্রী চরণ যুগলে। হাড়ের ভেতরে সেঁধিয়ে যাওয়া নবদ্বীপ হাটের শ্মশান শূন্য শিরিষ গাছের পাতার শিরশিরে ভয়ের নিঁভাজ ত্রাস। রগে রগে ছত্রাকার। ‘তৃষ্ণায়’ জলপান ঈশ্বরের নির্দেশ’ ফিশফিশিয়ে বলেছিল ব্রক্ষ্মচারী । নিঃশ্বাস ঘন আর ভারী হয়ে এসেছিল ব্রহ্মচারীর । ইন্দ্রানীকে বলেছিল ‘জলপান কর । ঈশ্বরই উদ্ধার কইরবেন।’ আর তারপরই নবদ্বীপ হাটের জনশূন্য একটি পরিত্যাক্ত ভাঙ্গা ঘরের নোংরা আর ঠাণ্ডা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রানীকে সন্ন্যাসী বাবা তার কুলুঙ্গির আশ্রমে।
সেখানেই সন্নেসী বাবার দুটো প্রসারমান শক্ত সমর্থ হাতের এড়ো কব্জিতে বিঁধে গেল ইন্দ্রানী। আত্মহত্যায় নিমগ্ন হলো। ওদিকে হ্র হর কড়্ কড়্ শব্দের বজ্রপাতে ছোট্ট জলাঙ্গীর জলে তুমুল তোলপাড়ের বন্যা বয়ে গেল। নষ্ট হয়ে গেল ইন্দ্রানী।   ------ এরপর যখন বেড়িয়ে এলো বিদ্ধস্ত ইন্দ্রানী সন্ন্যাসী বাবার কুলুঙ্গি আশ্রম থেকে তখন আত্মহত্যার প্রথম সিদ্ধান্তে বড় কঠিন, বড় কঠোর ওর দেহী চৈতন্য। যার তুলনা দ্বীপহীন দ্বীপান্তরের অসার শুন্যতা জড়ানো হাহাকারের অন্য নাম। দৌড়–তে শুরু করলো ইন্দ্রানী আক্রান্ত তাড়নায় আহত লীলাবতীর ঝিলমিল লজ্জ্বা ভেঙ্গে। সামনেই জলাঙ্গীর জল। তরঙ্গে দ্বিতীয় মৃত্যু সন্দেহে মুক্ত। কিন্তু হলো না। চ্যুতি ঘটলো প্রথমবার। সব গোলমাল করে দিল ঈশান নূরের কল্পচিত্র। জলাঙ্গির সব জলে দোলায়মান ওপাড়ের মিলিটারী ক্যাম্প, ওখানেই এখন ঈশান নুর। ইন্দ্রানীর ইন্দ্র, ব্রহ্মা-টা বড় ছোট। ‘ইন্দ্র কি বাঁচবে আর?’ নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো ইন্দ্রানী। তারপর পা বাড়ালো ইন্দ্রানী জলাঙ্গীর ওপাড়ে মিলিটারি ক্যাম্পের দিকে। এতটুকু বিচলন ছাড়াই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারলো না ইন্দ্রানী সেখানে। নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো ইন্দ্রানী। ব্রহ্মচারীই প্রথম নষ্ট করেছিল ওকে। তারপর তুলে দিয়েচিল দুর্গাদাসের হাতে।

‘ইন্দ্র যে আর নেই।’ মাইরে ফেলাবি নে ওরে মিলিটেরিরা। উদ্ধারের পথ!’ তিন কুল শূন্য ইন্দ্রানীর বিলাপ। অনুসন্ধানেই উদ্ধার। ঈশ্বর আদেশ লংঘন করে আমিতো পাতকি হতে পারিনে। নিঃশব্দে একটু হাসে দুর্গাদাস। আরোও একটু ঘনিষ্ঠ হতে চায়। ইন্দ্রানীর দেহভাণ্ডারেই খুঁজে পেতে চায় দুর্গাদাস তার ঈশ্বরকে।

‘বুঝলি তখন মনি হয়তো জীবিতকালে তোর এ কৃষ্ণের শ্যামশোভা দেহভাণ্ডে নিজের স্থান কইরে নেয়া আর তীর্থে ভক্তের মরণে তিল মাত্র ব্যবধান নেই। আর পরকালে? সে তো তোরও জ্ঞান গম্যির মধ্যেই- ডোমের ইচ্ছেয় ঈশ্বরের কানেও আগুনের তাপ উইঠে আসে।’ এবার একটু শব্দ করেই হাসে দুর্গাদাস। হাসির শব্দটায়  একটা ফ্যাঁস ফ্যাঁসে জাতীয় অতি শব্দ ক্রিয়াশীল থাকে শেষ পর্যন্ত। ইন্দ্রানী কিছু বলে না। পায়ের নখে মাটির রক্ত ঝরায়। মিলিয়ে যাবার আগে হাসির সরু লেজটিকে আকড়ে ধরে আবার কিছু বলতে চায় দুর্গাদাস কিন্তু পারে না।  উচ্চারণটিও থেমে যাবার উপক্রম করে। তবুও টেনে টেনে বলে শেষ পর্যন্ত  ‘মাইনি- তুইও যদি কোনোরকমে সেভাবে ইট্টু নষ্ট নষ্ট হইয়ে যেতি পারতিস!’ এই ইন্দ্রানীর নষ্ট হয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষার নেপথ্যে কাজ করে দুর্গাদাসের আর্থিক অসচ্ছলতা। ইন্দ্রানী নষ্ট হয়ে গেলে সে তার দেহটি বিক্রি করে কিছু বাড়তি রোজগার করতে পারতো। ওর আর্থিক সচ্ছলতা প্রাপ্তির সম্ভাবনাটি উজ্বল হয়ে উঠতো। চমকে উঠে তখুনি আবার দীর্ঘদিনের অভ্যাসলব্ধ শক্তি দিয়ে কোনরকমে সামলে ওঠে ইন্দ্রানী। সহ্য করে নেয় শান দেয়া কথার ছুড়ির আঁচড়টিকে। সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে হয়ে যায় উত্তরটাই দিয়ে দেয় যথাযথ-
‘তালি অন্ততঃ মরণ চিতেয় আগুন দেবার শেষ ভরসা একটা জোটানো যায়।’ কিন্তু আর এগুলো না ইন্দ্রানী। জিভটা শামুকের মতো গুটিয়ে নিলো মুখের খোলসে। দাঁতের ধার দিয়ে ঋতুবতী মেয়ে মানুষের নেতানো সংযমিতা দিয়ে নিজের ঠোঁট কাটে। যত কিছুই হোক ইন্দ্রানী আজকে নববধূ। জীবনের প্রথম বিয়ের লজ্জায় লজ্জিত লীলাবতী। এ সময় ঝগড়া ঝাটি করতে চায় না ইন্দ্রানী। এ সময়ে ঝগড়া ঝাটি নাকি আসলেই অলক্ষুণে- আর এটিই সত্য বলে মনে হয় ইন্দ্রানীর কাছে অন্তত এই মুহূর্তে।
কিন্তু দুর্গাদাস জানতো না যে ইন্দ্রানী ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ইন্দ্রানী আর নিজেকে তৈরী করেনি ওর ইন্দ্র ঈশান নুরের জন্যে। ভালবেসেছে কিন্তু কখনোই আর নিজের করে পেতে চায়নি। ইন্দ্রানী বুঝে নিয়েছিল এবং মাঝে মাঝে নিজেই আনমনে ফিসফিস করে উচ্চারণও করতো ‘এই নষ্ট দেহটা দিয়ে তো আর ইন্দ্রের পুজো হবি নে। হে ঈশ্বর ইন্দ্ররে তুমি বাাঁচায়ে রেইখ।’ আর তখনই দুর্গাদাসের কর্কশ কণ্ঠস্বর  শুনতে পায় ইন্দ্রানী। কি যেন বলছে অত্যন্ত ককর্শ কন্ঠে দুর্গাদাস। কিন্তু গ্রাহ্য করলো না ইন্দ্রানী।

০৩. সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা রাজনীতির মর্ম আর অর্থনীতির সূত্র- এসবের কিছুই বোঝে না ইন্দ্রানী, বুঝবার কথাও নয়। শুধু বোঝে যুদ্ধ আর শেখ মুজিব। সবার কাছে যেমন ইন্দ্রানীর কাছেও তেমনি শেখ সাহেব। শেখ সাহেবই যুদ্ধটা বাঁধিয়েছে। নইলে শূন্য থালার নষ্ট এনামেলে উপোসী মুখের ফ্যাকাশে ছায়াতেও ছিল অপার সুখ। রাতের ঘুমে বিঘ্নহীন তৃপ্ততা। তারপরেও অন্তরের অতি নিভৃত কোণে সযতনে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠা করেছিল শেখ সাহেবকে ইন্দ্রানী। বড় ভালো লাগতো মানুষটিকে ইন্দ্রানীর। কেন ভালো লাগতো জানে না ইন্দ্রানী। একেবারে দেবতার মতো। একমাত্র সে-ই তো পারবে এ অভাগা দেশটিকে স্বাধীন করতে। তার মতো মমতার যমুনা আর কেউ নেই যে। আর সে কারণেই মানুষটিকে বড় ভালো লাগত ইন্দ্রানীর। নবদ্বীপ হাটের কোলাহলের চূড়ায় থোকা থোকা জটলার বিদ্বেষের মেলায় ঈশান নুরের ছায়া যখন পরে ইন্দ্রানীর বড় ভালো লাগে দুর্ভিক্ষের হাটে আকালের সন্ধান করতে। ক্লান্তি আসে না, শুধুই ভাবতে ইচ্ছে করে  ইশান নুরকে।  ওর একান্ত নিজের ইন্দ্রকে। ইন্দ্র তো ওরই। শুধু একার ওরই। বুকটা প্রচুর নিঃশ্বাসের জায়গা দিতে পারে না। থিক থিকে স্বপ্নের কাদায় ভরপুর হালকা ফুসফুসের ছোট্ট চত্বর।
লোকে বলে- ‘নির্ঘাৎ নরকবাস’।
‘রাজার বিরুদ্ধে প্রজার আস্ফালন। এ যে বিলক্ষণ লয়ের লক্ষণ।’ জলধরের এই কথাগুলিতে শিরাগুলি টন্ টন্ করে ছিঁড়ে গেলেও ইন্দ্রানী তখন গভীর আত্মমগ্নতায় নিমজ্জিত হয়ে ইন্দ্রের কথায় অবিচল সান্ত¦না খুঁজে পেতে চায়।
‘এ দেশটার কিছু হবিনে রে ইন্দ্রানী। মানুষগুলি সব চামারের পোনা। খালি পাকিস্তানী মিলিটেরীর জুতোর শুকতলা চাইটে, চাইটে নিজেদের ছেরাদ্দ ডেইকে আনে।’
‘চাটবি নে! ভাতই পায় না যে।’ ইন্দ্রানীর নির্লিপ্ত ছোট্ট উত্তর। পেটের নাড়ীতে আকুলি বিকুলি পাক খায়। ঝট্ করে তেঁতে উঠে ঈশান নুর-
‘ভাতের থালা কে কবে কার জিভের ডগায় তুইলে দিয়েছে? ও কাইড়ে নিতে হয়।’
‘শক্তি থাকলিতো!’- খিল খিল হাসিতে ভাংতে থাকে ইন্দ্রানী। ভাংতে ভাংতে একেবারে ঈশান নুরের দেহের সাথে লেপ্টে যায়। আদর করে না ঈশান নুর। চোখের তারা দুটি শুধু অন্তর কাঁপায়।
‘এ সোমাজটারে উল্টোয়ে দিতি হবি রে ইন্দ্রানী। নইলে বাঁচতে পারবিনে। তুইও নে, আমিও নে। ’
আবারও হাসে ইন্দ্রানী।
‘কি যে কও তুমি বকা খাওয়া জোরো রোগীর মতো। মাথার ঘিলু গুলোন সব পইচে গেছে তোমার। এর চে ভাল দেয়ে আমাগের কুনো কাম আছে , না ও আমাগের কপালে সইহ্য হবি?’
অতি ঘোর ক্ষুব্ধ চেতনায় কাঁপতে কাঁপতে ধুক পুক শব্দ তুলে পাকস্থলীর অতল থেকে ফিস ফিস নিস্তরঙ্গ অথচ হড়হড় করে কি যেন একটা বেড়িয়ে আসতে চায় ইন্দ্রানীর গলা ফুটো করে। গলগল করে বমি করে দেয় ইন্দ্রানী ঈশান নুরের পায়ের কাছে। বমি শেষে অসহায়ের মতো তাকায় ঈশান নুরের দিকে অপলক। কিছুটা সময় নিয়ে সামলে নেয় নিজেকে। শাড়ীর আচলের কোনা দিয়ে মুখটা মুছে নেয়। তারপর আবার বলে
‘তার চে চলো একখানা চালা বান্ধি। পায়ে পায়ে টিপে, টিপে আসতিছে তো আর একজন। জায়গা কইরে রাইখতে হবিনে এখুনি?
আচমকা আড়ষ্টতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চায় ঈশান নুর। নিগুঢ় নিস্তব্ধতায় শা- শা সিসে ঢালে দু’কানের দু’পর্দায়। উধাও শব্দের দমকা হাওয়ায় গুড়িয়ে যায় দাঁড়াবার আশ্রয়। অন্ধকারের ডানার নিচে অদৃশ্য হয়ে যায় নবদ্বীপ হাট। ভারী বাতাসে হোঁচট খায় ঈশান নুরের কণ্ঠস্বর।
‘এ সোমাজে নোতুনের জায়গা হয় না রে ইন্দ্রানী। ওর জন্যি চাই আর এক নতুন সোমাজ। হাতুড়ি আর শাবলের আঘাতে আঘাতে ওই সোমাজরে তৈয়ের করতে অয়। আর এই তৈয়ের কইরবের জইন্যে উদোমতন্ত্রের ভারী দরকার হয়। খালি খালি স্বপ্নের মইধ্যে ডুইবে থাকলি কিছুই পাওয়া যাবি নে। এই উদোম গায়ের মানুষ গুলিনরে এক সাথে কইরে, ওদের সব হাত গুলিনরে দিয়ে একটি মাত্র পোক্ত হাত বানাইয়ে সেই হাত দিয়েই হাতুরীর আঘাত কইরে এই সোমাজটি ভাংবার জন্যি  আমাগের শ্যাষ আঘাতটি হানতি হবি। এর বাইরে আর কোনো কতাই নেই যে।’
‘সেইটে আবার কি রকুম সোমাজ?’ ছোট্ট প্রশ্ন ইন্দ্রানীর। ‘সেইটেই তো আসল সোমাজ। যারে বড় বড় বুদ্ধিঅলা লোকেরা কয় ‘সোমাজতন্ত্র’। যে সোমাজে তুমি আমি সবাই সোমান। নোতুন কেউ আসতি চাইলে জায়গা আগেই কইরে রাখা হয়।’ ঈশান নূর ইন্দ্রানীর কথার জবাব এভাবেই দেয়।
‘তালি সোমাজতন্ত্রের সেই দুনিয়াটি তোমার বানাতিছোনা কেন? সেটি হলি তো এই হা-ভাত আর যম-ভাত থাকে না।’
‘সেই চেষ্টাই তো তলে তলে আমরা সব্বাই কইরতেছি। সেইটের জন্যেই তো আইজকের এই যুদ্ধ। এত রক্তের ধারা। শোন যত দিন আমরা সেই সোমাজরে বানাতি পারবো নে তত দিনের আগে কোনো নতুন অতিথিরে দুইন্যায় আসতে দেয়া যাবি নে।’ ঈশান নুরের কথায় প্রতারনার ইঙ্গিত স্পষ্ট। কিন্তু বুঝতে পারে না ইন্দ্রানী। ইন্দ্রানী শুধু বলে ‘তালি এখন কী হবি?’ প্রশ্ন করে ইন্দ্রানী।
‘ কিছুই হবি নে। ওরে নষ্ট কইরে ফেলতি হবি।’
আঁতকে উঠে ইন্দ্রানী-
‘কি কও ? আমি বাঁচবো কেমন কইরে?
‘ক্যান? আমারে নিয়ে। যারে এই সোমাজে জায়গা দিতি পারবিনে তারে আইনে কি করবি? তার চে মমতা জাগানের আগেই নষ্ট কইরে ফালানেই কি ঠিক না? যদি কুনক্রমে একবার সোমাজতন্ত্রটিরে আনতি পারি তালিতো আর অভাব বইলে কিছু থাকবি নে। তখন তো একটি ক্যান পাঁচটি আসলিও বাঁচায়ে রাখতি পারবি তুই।’ নিরুপায় হয়ে ঈশান নুরের এ কথাটিকে বিস্বাস করতে চায় ইন্দ্রানী।
‘সত্যই, সত্যি কথা বইলতিছো?’
‘ক্যান, আমার ভালোবাসায় তোর বিশ্বেসের অভাব আছে?’ -দৃঢ়তায় ভরপুর ঈশান নুরের পাল্টা প্রশ্ন।
এ কথা শুনবার পর ঈশান নুরের বুকেই মুখ লুকিয়েছিল ইন্দ্রানী। অনেক আদর করেছিল ঈশান নুর ইন্দ্রানীকে। সেদিনই নিধু কবরেজের কাছ থেকে ছ’টাকা পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে ওষুধ এনে নষ্ট করে দিয়েছিল ওর পেটের সন্তানকে। এর পর অনেকদিন প্রচণ্ড কষ্ট করেছিল পেটের সন্তানকে মা হয়ে নিজেই ওর জন্মাবার আগে নিজেই হত্যা করে। অনুতাপ অনুশোচনায় প্রচণ্ড দগ্ধ হতে হতে যেন প্রাণহীন হয়ে গিয়েছিলো ইন্দ্রানী। সন্তানটিকে নষ্ট করবার সময় ঔষধি ক্রিয়ায় রক্ত ক্ষরণ হয়েছিল অপরিমিত। সে সময় প্রচুর সাহায্য করেছিল ঈশান নুর। সব সময় কাছে কাছে থেকে ছিল ইন্দ্রানীর। দুজনের ভালোবাসা আরও গভীর থেকে গভীরতর হয়েছিল ওদের মধ্যে। ঈশান নুরের বলা- ‘সোমাজতন্ত্র’- কে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছিল ইন্দ্রানী।
এরপর ঈশান নুরের ঐ উদোমতন্ত্রের শ্রুতিটিই লোকে, লোকে, কালে, কালে ধাবিত হয়ে সমাজতন্ত্র নামের দু’বেলা পেটপুরে খাবার বর্ণিল বস্তুটি নবদ্বীপ হাটের উপোসি মানুষগুলির কাছে বহু বিস্তারে বর্ণিত হয়ে গিয়েছিল বিচিত্র পথে। লোকে জানত এবং বিশ্বাস করতো ঈশার নুর সমাজতন্ত্রের মানুষ। মাটির নিচে ওর সব কাজ কারবার। ঈশান নুরের কথাতেই এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে  আসা ইন্দ্রানী ওর সমাজতন্ত্রের প্রখর উদ্দীপনা। দেশটা এবার আর উদ্ধার না হয়ে যাবে না কিছুতেই। এরই ধারাবাহিকতায় বোধকরি মাঝে মধ্যে কিল বিল করে তেড়ে আসতো উদোম গায়ের খুচরো ছেলে ছোকড়াদের চিৎকার করা মিছিল। ভাঙ্গাচোরা ফেস্টুন, উচ্ছ্বাস আর অস্থির কোলাহলে কিম্ভুতকিমাকার হয়ে যেতো সব কিছু। এত ভারী দুঃখ পাবার পরেও হাসির বুদ্বুদ ওঠতো ইন্দ্রানীর তলপেট মুচড়ে দিয়ে।
‘উদোম তন্ত্রের শাস্ত্রী সেপাইদের উপোসের কাল এইবার কাটাইল বইলে।’ তিতেটে ঢেকুর গিলেও অঘ্রানের বিকেলের এক  ফোটা রোদের অনিবার্য একটি ‘সুখবৃত্ত’- রচনা করতো ইন্দ্রানীর একরত্তি চোখের তিরতিরে দুটি কৃষ্ণকালো  উজ্জ্বল তারায়। ঈশান নুর তো এ তন্ত্রেরই নেতা। পরপরই নিজের ভেতর কেন জানি আবার আতঙ্কের উতুঙ্গ বিবমিষা আলোড়ন তুলতো । অলক্ষুণে একাত্তরটা যদি সকালের আগেই বেঘোরে নিপাত যেতি পারতো !‘আবার নিষ্প্রাণ হয়ে যায় ইন্দ্রানী। উজ্জ্বল কালো চোখের তারা দুটি থেকে এক এক করে সব আকাক্সক্ষার আলো আবার নিভে যেতে শুরু করতো।

অবোধ্য, অসম্পূর্ণ বিশাল বোধের চরাচরে একটি ছিদ্রহীন সম্পূর্ণতা যেন নির্জন নিশ্চেতনতার গহীন গাঙ্গে চেতনার সুতো কাটে- নোংরা গোবরে পোকার চির্-র্, চির্-র্- শব্দ তুলে। পাজরের নীচে আকণ্ঠ নিমজ্জমান ধুকধুকে হৃৎপিণ্ডটি শ্বাসকষ্টে চিড়ে চিড়ে যায় বেধড়ক কুঁড়ে যাওয়া বিশ্রী শব্দের ঘুর্ণিপাকে নীলাভ কুয়াশার ছড়ানো ধোঁয়া আর সেই নীল আগুনের মিহি শিখার ডিগবাজীর শব্দে ডুবতেই থাকে ইন্দ্রানী অজ্ঞাত এক আশঙ্কার খণ্ড খণ্ড ঝোপঝাড় দুমড়ে মুচরে দিয়ে। নবদ্বীপ হাট দোল খায় আকাশচারী মুলি বাঁশের সরু কঞ্চির ডগায়। উৎরাই ভাঙ্গা বাঁধের চিক চিকে বালির জ্যোৎস্নার অন্ধকার থমকে দাঁড়ায়। চকচকে বর্ষার তীক্ষ্ণ ফলায় ঈশান নুরের চারকোণে মাথাটা গোটা চরাচরকে একাকার করে ফেলে। প্রহর ঘোঘণায় উচ্চকিত শেয়াল কুলের একত্রিত অবিরাম শব্দবান হুড়মুড় ধাক্কা খেয়ে ডানা মেলে দেয় যেন আরও দূর, বহুদূর শুন্যালোকের জমাট বাধা অখণ্ড নিস্তব্ধতায় । কিন্তু পরক্ষণেই আবার সে নিস্তব্ধতার চির ধরা ফাটল থেকে তাড়িত হয়ে সেই নীল আগুনের মিহি শিখা মাটির ওপরের সবুজ ঘাসের আকাশমুখী ডগায় নীল আগুনের ফুলকি হয়ে সে মিহি শিখা আর নীল কুয়াশার ফেনিল বুব্ধুদ ঢেউহীন সমুদ্রের প্রশান্ত জলের মতো নিঃসীম চেতনাহীনতার ডিঙ্গিতে আশ্রয় খোঁজে।

‘বাতাসের তোড়ে সব থেইমে গেল ক্যান্? কইলজের ভেতরটি ফাইটে যায় যে।’ নিজেকে প্রশ্ন করে কোন উত্তরই খুঁজে পায় না ইন্দ্রানী। নীল কুয়াশার ছোপ ছোপ ফেনা আর নীল আগুনের মিহি শিখার মুখোমুখি ডিগবাজীতে - সমাজতন্ত্রের ক্ষরিত রক্তে ভাসতে থাকে ইন্দ্রানীর সুখ আর সুখের সব অলীক কল্পনা। ইন্দ্রানীর অন্তরটি হয়ে যায় ক্ষোভ আর অভিমান মিশ্রিত ঘৃণার ভাগাড়।
বুদ্ধির ঝিল্লিপুঞ্জে পাক খেতে খেতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় চৈতন্যের ধবল লাশ। অপসৃয়মান প্রকৃতির জন্মাদ্ধ বস্তনিচয়ের প্রগাড় উৎকণ্ঠায় ঠুকে গিয়ে চুরমার হয়ে যায় মিলিটেরি ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে হঠাৎ করেই নবদ্বীপ হাটের চেয়ারম্যান হয়ে যাওয়া ইন্দ্রানীর আজন্ম লালিত স্বপ্ন, ইন্দ্রানীর একান্তই আপনার ইন্দ্র- রাজাকার ঈশান নুর। এই কি সেই ঈশান নুর। নাকি ঈষান নুরের অবাস্তব বীভৎস, বিকৃত প্রতিমূর্তি ঈশান নুরের ছায়ার জান্তব শরীর। রাজাকার ঈশান নুরের সমাজতন্ত্রী রাজনীতির আধ্ম্যতিক উচ্চারণ ‘সমাজতন্ত্রে ঈশ্বর নেই। ঈশ্বরে নিজেরে সমর্পণ কর। উইদ্ধের তিনিই কইরবেন।’

ইন্দ্রানীকে গ্রহণ করতে চেয়ারম্যান ঈশান নুরের সরাসরি অস্বীকৃতি। দ্রুত পায়ে দৌড়ে কোনোরকমে পালিয়ে এসেছিল ইন্দ্রানী ঈশান নুরের সামনে থেকে। সোজা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল চিৎ হয়ে। হোগলার চালার অসংখ্য  ফুটোয় আটকে গিয়েছিল টুকরো টুকরো অসংখ্য ঈশান নুর। সংখ্যাতীত বুক চেরা আকুলি বিকুলি ইন্দ্রানীর বার বার এ টুকরোগুলির সাথে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল ইন্দ্রানীর কাছেই। উত্তর যা পেয়েছিল তাতে অবশিষ্ট আর কিছুই ছিল না। সব শুন্য হয়ে গিয়েছিল। কেমন একটা চরম অবজ্ঞার চাকচিক্য ঝলসে উঠেছিল ঈশান নুরের ঐ উত্তরের সবটা জুড়ে।

ইন্দ্রানী আশ্চর্য হয় না। রাজাকার চেয়ারম্যান এ ঈশান নুর তো তার সেই সমাজতন্ত্রী ইশান নুর নয়। এ ইশান নুর তো পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যদের সাক্ষাৎ প্রেতাত্মা। অথচ এই ইশান নুরের সমাজতন্ত্রের আওড়ানো বুলিতে বিশ্বাস স্থাপন করে নিজেই হয়ে গিয়েছিল ইশান-নুর কথিত সমাজতন্ত্রের চরম শিকার। ‘সোমাজতন্ত্রে  সকলের অধিকার সোমান’- ইশান নুরের এই কথাটির সত্যতা খুঁজে পেয়েছিল ইন্দ্রানী শুধু মাত্র তার শরীরটির উপর ভোগ করবার সকলের অধিকার সমানভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রটিতে। আর কোথাও নয়। সবশেষে আশ্চর্যতম বিষয় নবদ্বীপ হাটের উদোমতন্ত্রী হাজার হাজার উপোসী মানুষের জমাটবদ্ধ শ্লোগানের তীব্র চিৎকার আর তাদের হাতে রক্ষিত তীক্ষ্ণ বর্ষা ফলায় আমুল বিদ্ধ ইশান নুরের নিষ্প্রাণ দেহটা খুব কাছাকাছি থেকে দেখেছিল ইন্দ্রানী। চিৎকার করে ওঠেনি ইন্দ্রানী, কাঁদেও নি শব্দ করে। শুধু দু,ফোটা করুণার অশ্রু ঝরে পড়েছিল ওর দু’চোখের কোণ্ বেয়ে। এই হাজার হাজার উপোসী মানুষের জমাট বাঁধা শ্লোগানের চিৎকারে ইন্দ্রানীর অতি তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরটি শুধু হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হারিয়ে যায় নি ওরও হাতে রক্ষিত অতি ক্ষুদ্র বর্শাটির তীক্ষ্ণ ফলাটি।

পরদিন দেখেছিল ইন্দ্রানী জলাঙ্গির তীরের বালু চরের জ্যোৎস্নার চিকচিকে বালির গভীরে অর্ধেক সেঁধিয়ে যাওয়া ঈশান নুরের চারকোণে মাথাটি। আর সেই নীল কুয়াশার ছোপ ছোপ ফেনিল বুদ্বুদ আর নীল আগুনের মিহি শিখার একত্রিত প্রচণ্ড উল্লাস। ক্রমান্বয়ে কুয়াশার সেই নীল রং আর নীল আগুনের মিহি শিখা শূন্যলোকের অসীম স্বাভাবিক নীলের সাথে আরও নীলাভ হয়ে যেতে থাকলো।
জোড়া লাগা ঠোঁটের রেখায় ঝড় ওঠে ইন্দ্রানীর। ছিড়ে যায় অতি মসৃণ আর পাতলা ঠোঁটের পরত।  ফিস্ ফিস্ করে শব্দ হয় ঠোঁটের চড়ায়। সেই পুরনো শব্দ ‘তালি আমি একাই  সোমাজতন্ত্রের ক্ষ্যাত হইয়ে গেলাম ক্যান?’ উত্তর বিহীন বিশাল প্রশ্ন। কে দেবে এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর? এমেন আছে কি কেউ? না, নেই একমাত্র ঈশান নুর ছাড়া। কিন্তু সে তো এ প্রশ্নের সঠিক উত্তরটি দেবে না।

০৪.
আত্মহত্যা করা হয় না ইন্দ্রানীর।  ডুবতে থাকে সেই ছোপ ছোপ নীল কুয়াশার অসংখ্য বুদ্বুদের অতলান্ত থেকে অতলান্তে। ‘ইন্দ্রানীরে মিলিটেরিরা আমার দুই চোখ খুইলে দে গেছে। মিলিটেরি ক্যাম্প থেকে ওদের দেয়া রাইফেলটিসহ রাজাকার হইয়ে না ফিরলি আজ আমি কি আর নবদ্বীপহাটের চিয়েরম্যান হতি পারতেম? কিন্তু তুই যে একেবারে পুরোটাই ‘কমুনিস্টোর’ ধ্বজা উড়োয়ে দিলি। আমি অনেক ভেইবে দেইখেছি ও বড়ই স্যাতস্যাতি। তাই আর ভিজে কাঁথা গায়ে জড়াতে চাই নি। সোজাসুজি রাজাকার হইয়ে ফিরে এইসে এই নবদ্বীপ হাটের চিয়েরম্যান হইয়েছি। আসলে নবদ্বীপ হাটের মানুষগুলি বড় বেশি ভালো। আমারে ঠিকই চিইনে নিইছিল। তা না হলি আমারে কি আর রাজাকার জাইনেও এই নবদ্বীপ হাটের চিয়োরম্যান বানাতো?’ ঈশান নুরের আত্ম-অহংকারের বিকট প্রকাশ।
এতগুলি কথার উত্তরে ইন্দ্রানী শুধুমাত্র দুটি প্রশ্ন করেছিল-
‘তালি আমারে তুমি ‘সোমাজতন্ত্রের’ ক্ষ্যাত বানাইলে ক্যান? ক্যান আমি সোমাজতন্ত্রের ক্ষ্যাত  হইয়ে গেলাম?’ উত্তর শোনার জন্যে আর দাঁড়ায় নি ইন্দ্রানী। শুধু নিজের দুটি হাতের তালুর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ, দেখছিল হাত দুটির তালুতে, আঙ্গুলের ডগায় আর নখের গভীরে রক্তের ছোপ এখনও লেগে আছে কি না। এরপর এক অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছিল ইন্দ্রানী। যেন অনন্তকালের এ যাত্রা। যার কোন শেষ নেই। চলতেই থাকবে ইন্দ্রানীর প্রতিহিংসা আর আত্মহননের অভিলাষের ওপর আত্ম-প্রতিষ্ঠার অহংকারের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে আপন অন্তর্লোকে অন্তর্গত হয়ে অবিশ্রান্ত। অপার মহাশূন্যের সীমা ছড়িয়ে যাওয়া অসীমতার কোন শেষ নেই যে। প্রকৃতই আছে কি? নেই। আর এই-ই তো স্বাধীনতা।