প্রক্ষেপণ | সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক

প্রক্ষেপণ | সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক
০১. অতঃপর ইন্দ্রানী আত্মহত্যার শেষ সিদ্ধান্ত থেকে আবারও চ্যুত হলো। অবশ্য এবারের ওর সিদ্ধান্ত চ্যুতির পরিকল্পনা অকারণ অন্তরঙ্গতা-আকীর্ণ উপলব্ধির কারণটিও একটু ভিন্ন ঢংয়ের। কবে কোথাকার কোন এক অসভ্য নাগরিক-অসভ্যতার নর্দমার কর্দমাক্ত জীবাণুর মতো উৎসহীন ঈশান নুর কোথায় বলেছিল-‘ইন্দ্রানীরে গাঙের পানিও সব শুকায়ে গেল, তুইও কমিউনিস্টো হইয়ে গেলি। ওদিকে সবাই যে খালি চাটতিছে। তবুও পুরোটাই কম্যুনিস্টের স্যাতস্যাতি ধ্বজা উড়োয়ে দিলি’ নবদ্বীপ হাটের নতুন রাজাকার চেয়ারম্যান ঈশান নুরের ব্যাঙ্গ মিশ্রিত তিরস্কার।

সহ্য করতে পারেনি ইন্দ্রানী। মুহূর্ত কয়েক বিব্রত বোধ করেছিল মাত্র। সামান্য এক চিলতে কপালে দু’তিনটে অসামান্য রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল দ্রুত। কপালের সাথে যোগাযোগ করে চোখ দুটিও যেন ছোট হয়ে এসেছিল স্বাভাবিকভাবেই। শুধু তারা দুটি যেন হঠাৎ করেই দপ করে জ্বলে উঠে আবার নিভে গিয়েছিল রাতে ব্যবহার করা অত্যাধুনিক ক্যামেরার তীব্রভাবে জ্বলে ওঠা ফ্ল্যাশ বাল্বের সিলভার-কালার বৈদ্যুতিক আলোর ঝিলিকের মতো। ঠাস করে একটা শব্দ ম্লান অন্ধকারকে সঙ্গে সঙ্গেই দুর্বোধ্যভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছিল যেন। হাতটা দ্রুতই এসে পড়েছিল ঈশান নুরের গালে। একেবারে তামাটে হয়ে যাওয়া কুচকুচে কালচে গালের উপর। ঈশান নুর চমকে ওঠে নি। আশ্চর্যও হয় নি- দেখছিল শুধু ইন্দ্রানীকে। অপলক দৃষ্টিতে নয়- পিট পিট করে। জিহ্বাটা বেরিয়ে এসেছিল ঠোঁটদুটিকে ভিজিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু ঠোঁট দুটিকে ভেজাতে পারে নি। শুকনোই থেকে গিয়েছিল।

আর দাঁড়ায় নি ইন্দ্রানী। সোজা চলে এসেছিল নিজের ঘরে। ঘরে ঢুকেই টনটনে এক যন্ত্রণার মতো শুকনো বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরী ভাঙ্গাচোড়া টং জাতীয় একটি বস্তুর উপর শত ছিন্ন কাঁথা দিয়ে মোড়ানো বিছানা নামের অসহ্য একটি অত্যাচারের কাছে অবলীলায় সমর্পণ করেছিল নিজেকে প্রচণ্ড একটি উত্তেজনার আকর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্যই বোধ করি। এপাশ ওপাশ করছিল কয়েকবার। তারপর একেবারে শ্রাবণের সাথে একাকার। হয়তোবা বোধগম্যতার বাইরে এক ধরনের অর্থহীন ব্যর্থ অভিসারের ফলাফলের মতো। অবশেষে অনেকক্ষণ ধরেই নীরবে কেঁদেছিল ইন্দ্রানী। পাশ ফিরে সোজা চিত হয়ে চোখের দৃষ্টি বিস্তৃত করে দিয়েছিল হোগলার চালার অসংখ্য ফুটোয়। আটকে গিয়েছিল সে ফুটো গুলিতে টুকরে, টুকরো খণ্ড, খণ্ড অসংখ্য  ঈশান নুরের বিবর্ণ মুখ। চোখ দুটোকে ঝাপসা করে তুলেছিল। ইন্দ্রানীর অসংখ্য বুকচেরা আকুলি বিকুলি বার বার ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল আবার ইন্দ্রানীর কাছেই ঐ টুকরোগুলোর সাথে সাথে। শেষ উত্তর যা পেয়েছিল তাতে অবশিষ্ট আর কিছুই ছিল না। সব শূন্য হয়ে গিয়েছিল। কেমন যেন একটা অবজ্ঞার চাকচিক্য ঝলসে উঠেছিল উত্তরের সবটা জুড়ে। ‘ইন্দ্রানীরে মিলিটেরিরা আমার চোখের পর্দা খুইলে দেয়ে গেছে। রাজাকারের রাইফেলটাই আমারে নবদ্বীপের হাটের চিয়েরম্যান কইরে দিতি পেরেছে। কিন্তু তুই যে একেবারে পুরোটাই কম্যুনিষ্টোর ক্ষ্যাত হইয়ে গেলি!’ একটি কুৎসিত তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠে ঈশান নুরের কন্ঠস্বরে।

‘কি কইলা? তালি আমারে কম্যুনিস্টোর ক্ষ্যাত বানাইলো কে? আর আমিই বা ক্ষ্যাত হইয়ে গেলাম ক্যান্। আমার উইদ্ধের?’- ইন্দ্রানী অসহায় আক্রোশে চিৎকার করে উঠতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই ঐ টুকরোগুলি চূর্ন বিচূর্ণ হয়ে চুইয়ে চুইয়ে নির্ঝরের মতো নেমে আসতে শুরু করেছিল ওর চোখের পাতায় অমৃতের নয় বিশুদ্ধ গরলের জোয়ারের মতো ইন্দ্রের আধ্যাত্মিক রাজনীতিকে সাথে নিয়ে। ইশান নুর যেন এ কথাকটিই বলতে চেয়েছিল ‘সোমাজতন্ত্রে ঈশ্বর নেই। ঈশ্বরে নিজেরে সমর্পণ কর, উইদ্ধের তিনিই কইরবেন।’ বুঝতে পেরেছিল ইন্দ্রানী। শেষে এক সময় নিজেই থামিয়ে দিয়েছিল নিজের সে কান্নাকে। উঠে বসেছিল বিছানার ওপর। স্বাধীনতার বুকভরা নিঃশ্বাসের মতো দৃষ্টিকে সীমার বাইরে ছড়িয়ে দিয়ে উচ্চারণ করেছিল মাত্র দুটি শব্দ। জিভের লালা দিয়ে ভরে যাওয়া চকচকে পুরুষ্ঠ ঠোঁট দুটির ফাঁক  দিয়ে ঝিকঝিকে সাদা দাঁতের ডগা ছুঁয়ে বেরিয়ে এসেছিল ‘আত্মহইত্যে- আর না।’

বেরিয়ে পড়েছিল ইন্দ্রানী ঘর ছেড়ে। একটা দারুণ ক্রোধের সাথে রক্তারক্তি কিছু অভিমানের বেদনাকে মিশিয়ে দিয়ে একটা বিশাল অহংকারের সাথে প্রতারক কিছু অমর্যাদার তীব্রতাকে জড়িয়ে নিয়ে ওর নিজের মানুষ ইন্দ্রের খোঁজে। অনেক আগে থেকেই খুঁজে চলেছে ইন্দ্রানী ওর ইন্দ্রকে ওর অবসেশনের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু সেখানে কখনই খুঁজে পায় নি ঈশান নুরকে। আর দ্রুত গতিতে অপসৃয়মান কালকে যেন মনে হয়েছে আসলেই কালের উর্ধ্বে নিজের স্থান করে নিতে কিছু গাঢ় দ্বিধাহীনতায় ভুগে চলেছে সে। রেখে যাচ্ছে শুধুু দগদগে আর কিছু অসম্ভব গাঢ় ক্ষত চিহ্ন ইন্দ্রানীর সারা শরীরের আনাচে কানাচে। ক্লান্ত রক্তের কোষে কোষে টকটকে তাজা টসটসে ইন্দ্রানী হয়ে উঠেছিল রোদে দেবার আগে চিপে নেয়াা ভিজে কাপড়ের মতো। ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার শক্তিও যার ছিল না। অথচ সেই ইন্দ্রানী আজকে যেন বড় উদ্ধত, বড় বেশী ঋজু। সব খোঁজাখুঁজি শেষ হয়ে গেছে। অথচ এ মুহূর্তটিতেই ওর কেন যেন মনে হলো সে যেন খুঁজে পেয়েছে তার ইন্দ্রকে। দাঁড়িয়েছে একেবারে ইন্দ্রের মুখোমুখি। আজকে হলদে ভোরের রাত্রি থেকে ছিটকে বেড়িয়ে আসবার সামান্য কিছু মাত্র আগেই দাঁড়িয়েছে একেবারে ইন্দ্রের মুখোমুখি। প্রচণ্ড বেগে হেসে উঠতে চেয়েছিল ইন্দ্রানী। হেসেছিলও, কিন্তু শব্দের ক্ষীণতায় নিজেই কেঁপে কেঁপে উঠছিল ইন্দ্রানী বার বার- ভয় পেয়ে গিয়েছিল হয়তো বা শক্তির দীনতায় এ ক্রুদ্ধ হাসিটাই আবার কান্নার ভেতরে ডুবে যাবে মুহূর্তে। ভীষণ কষ্ট সহ্য করেও সংবরণ করে নিয়েছিল নিজেকে ইন্দ্রের সামনে। একেবারেই ওর চোখের তারায় রক্ত বর্ণ দুটি চোখে রেখে। কতকটা যেন অতি ঘোর অনিবার্য এক বিধ্বংসী দুঃসাহসে ভর করে। স্বপ্নটা দপ করে জ্বলে উঠেই আবার নিভে গিয়েছিল মুহূর্তে।

০২.                                                               
‘অই ছেনাল মাগী।  ঘুম যে ভাংতিছেনা বড়। রেতের বেলা কি গতরটারে মেইলে ধইরে সইন্যেসীগের শুইবের আসন পেইতে গিয়েছিলি? নাকি ঢলো ঢলো অঙ্গের উপর দে  আবার ব্যাধের কাফেলা পার হইয়ে গেছে ? ও-তো আবার তোর মইধ্য রেতের শাক ভাত।’ - দুর্গাদাসের গলা। কিছুুটা জড়ানো হলেও বড় খট্ খটে আর নির্মম। কথাগুলো কানে গিয়েছিল ইন্দ্রানীর। ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল অনেক আগেই কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করেনি। একটি তন্দ্রার মতো নরম আচ্ছন্নতা যেন জড়িয়ে রেখেছিল ওকে কেমন একটি মসৃণ পেলবতা দিয়ে। বড় দুর্বল হয়ে পড়েছিল ইন্দ্রানী। আর ওর সেই দুর্বলতার ভেতর দিয়ে কেমন যেন এক অদ্ভুত ধৃষ্টতার ছায়াও পড়েছিল ওর সব আচ্ছন্নতাকে ডিঙ্গিয়ে হৃৎপিণ্ডের রক্ত কণিকায়। নিসপিস করছিল প্রতিটি আঙ্গুলের ডগা। তীক্ষ্ণ নখের তীব্র আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছিল ইন্দ্রানী নিজেকে। রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল ইন্দ্রানীর হৃৎপিণ্ড থেকে।

ক্ষরিত সে রক্ত ধারার স্রোতে আবার লক্ষ করছিল ইন্দ্রানী কঠিন মাটির গভীরতাকেও দীর্ণ করে লকলকে একটা আগুনের মিহি শিখা যেন বেড়িয়ে আসছে অসম্ভব দ্রুত গতিতে ইন্দ্রানীকে সংহার করবার জন্যেই সম্ভবত। ভয়ে কুঞ্চিত হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রানী। সেটে গিয়েছিল গায়ে লবন দেয়া কেচোর মতো। মুখটা আপনা আপনি বেঁকে গিয়েছিল ইন্দ্রানীর। রক্তশূন্য রোগীর সাদা চোয়ালের মতো হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রানীর ভরপুর চোখমুখের অবিলোল লাবণ্য। চিৎকার করে উঠে নি ইন্দ্রানী। শুধু গলে গিয়ে দলা পাকানো মোমের মতো কুকরে গিয়েছিল মাত্র। ইন্দ্রানীর ধারণা হয়তো আত্মসংহারই ছিল ইন্দ্রানীর অনিশ্চিত আর অস্বচ্ছ ভবিষ্যতের জন্য মোক্ষম প্রয়োজনীয়। অথচ প্রয়োজন বোধ করেও সে প্রয়োজনের মূল্য দেয় নি ইন্দ্রানী। কাকে যেন পাবার এক প্রবল আকাঙ্ক্ষায় বিচলিত আর সম্মোহিত করে ফেলেছিল ইন্দ্রানীকে। কিন্তু কে সে? সেই কি ঈশান নুর?  ইন্দ্রানীর প্রথম প্রেম। ইন্দ্রানীর ইন্দ্র।

‘কইরে ইন্দ্রানী। কানের পর্দার ফুকরো দোরে কি ফাটকের তালা মেইয়ে দিইছিস। সোহাগের ডালাটা ইট্ট খুইলে ধরে উইদ্ধার কইরে দে দয়া কইরে আমারে।’ দুর্গাদাসের বিশ্রী তিরস্কার। ‘সোহাগের ডালার মুখ খুইলে দিয়েছি বইলেই না কাত্তিকের হিজরে কুইত্তের মতো ঝুইলে পড়া জিভ টান কইরে নালা নর্দমা, খানা ডোবা সব একাকার কইরে শুইকে বেড়াতিছো। নিজের মাগরে সুখ দেবার মুরোদ নেই তার আবার কস্তুরির সুবাস নেবার মাতামাতি। আমি রইয়েছি বইলেই তো সাড়ে তিন পহর পার না হতিই ন’কোশ, ছ’কোশ কইরতি পারতিছো । শরম মরদের বালাই, চণ্ডালের পাপ আর শুদ্রের জ্বালা।’  কথাগুলি বলে হাঁপাতে থাকল ইন্দ্রানী। একটা বেগবান জীবনের নিরন্তর প্রবাহ যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। সিদ্ধান্ত গ্রহণের শিথিল উপলব্ধিটা তরাণ্বিত হয়ে ঘণিভূত হতে থাকলো। উঠে দঁড়ালো ইন্দ্রানী। ক্ষণ কয়েক কি যেন ভেবে নিল। এদিক ওদিক দেখলো কিছুক্ষণ। আর সময় নেই ইন্দ্রানীর। এবার ছুুটতে হবে বুঝতে পারলো ইন্দ্রানী। আর এবারের এ ছুটে চলা হবে বিরামহীন, যতিহীন এবং অবিশ্রান্ত।

ইন্দ্রানী। বুকের ভেতর বাতাসের বান ডাকলো। ভাতের শূন্য থালায় আরশোলা তাড়ালো ডান হাতের তর্জনী দিয়ে। বালিশের উপরে টিকটিকি দেখেও দেখলো না ইচ্ছে করে। পা বাড়ালো জীবনের প্রথম সংসার নামের যুথবদ্ধ পিচপিচে কালাজ্বরের চৌহদ্দির বাইরে। ঘৃণায় ছোট্ট কপালের ঠিক কেন্দ্রে একটা চিহ্নের উদ্ভব হলো। সিদ্ধান্ত ঘন দুধের ঘনত্বের চাইতেও দৃঢ় হলো। বুঝতে পারলো ইন্দ্রানী সময় ফুরিয়ে গেছে। আর এখানে নয়। যে সিদ্ধান্তটি সে বাতিল করেছিল সে সিদ্ধান্তেই আবার ফিরে যেতে চাইলো ইন্দ্রানী। আত্মহত্যার সিদ্ধান্তটিই এই মুহূর্তে বড় কাছের মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেল। বড় আপনার হয়ে গেলো ওর। বড় উপযোগী মনে হল আত্মহত্যাটিকে। দৃষ্টি অসীমে অদৃশ্য হলো।
চন্দ্রদীপ আর কত দূর? যাবার সময় শুধু বলে গেল ‘তোমার সোংসারের কপালে আগুন। ঈশ্বর আমার মাতাই থাইক।’

দূর্গাদাস ইষৎ হাসলো। কোন প্রতিক্রিয়া হলো না দুর্গাদাসের ভেতরে অথবা বাইরে। ইন্দ্রানী নিজেও বুঝতে চাইলো না তার পুরোটা। শুধু বুঝলো ঐ হাসিটি বড় অবজ্ঞার, বড় ঘৃণার এবং আরোও বড় আত্মদম্ভের বুঝিবা। লক্ষ্য করল ঐ হাসিটির উপরেই মুদ্রিত একটি তিরস্কারের ঈঙ্গিতকেও।
‘যেতিছ যাও। তবে মইরবের আগে এই দুর্গাদাস পাড়ই অমৃতের সমান।’

ঘর ভেঙ্গে গেল দুর্গাদাসের। চলে গেল ইন্দ্রানী। দুর্গাদাসও আর মনে করলো না ইন্দ্রানীর মতো নিছক একটা নারকী পাপাত্মার জন্যে তিল মাত্র কালক্ষেপণের মধ্যে কিছুমাত্র যথার্থতা অথবা পুরুষতা আছে। প্রতিদিনের অভ্যেস আর নৈমিত্তিক নিয়মের সূত্র ধরে জুতো, চটি মেরামতের যন্ত্রপাতি, সরঞ্জামাদি ইত্যাদির বেঢপ দড়ি বাঁধা কাঠের বাক্সটিকে বাঁ কাঁধের উপর ফেলে দু’ঠোটের আঠালো কোনায় ছোট্ট একটা আধ পোড়া বিড়ির চুপসে যাওয়া পুরো গোড়াটিকে ঠেলে দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো দুর্গাদাস নবদ্বীপ হাটের পথে। খালি পা, ধুতির প্রান্তটি হাটু অবধি ওঠানো, উদোম গা।

এই নবদ্বীপ হাটেই প্রথম পরিচয় ইন্দ্রানীর সাথে দুর্গাদাসের। এবং শুধু পরিচয়ই নয়, সাথে সাথে পরিচয় থেকে সরাসরি একেবারে ঘরে তোলা পর্যন্ত। পরিচয়ের ঘটনাটি অবশ্য ঘটে যায় কোন এক ভিনদেশী গৃহত্যাগী সমর্থ যোগী অমৃতলাল ব্রহ্মচারীর সৌজন্যে কিছুটা আকস্মিকভাবেই। এবং তার চাইতে বেশী আকস্মিকভাবেই নির্দেশটিও আসে যোগীর কাছ থেকেই ইন্দ্রানীকে সরাসরি দুর্গাদাসের ঘরে তুলবার। দুর্গাদাসের ভাববার আর কিছু ছিল না। ঈশ্বরাশির্বাদ ভেবে ঢিপ করে যোগীর দুটো পায়ের লম্বা পাতায় আরো লম্বা একটা প্রণাম ঠেকিয়ে ওরই সামনে ওরই উচ্চারিত মন্ত্রের শুদ্ধাশুদ্ধ অনুকরণ করে ইন্দ্রানীকে তুলে নিয়ে গেল দুর্গাদাস ওর হোগলায় ঢাকা ভাংচুর শোবার ঘরের নোংরা কাথার চাইতেও ভাংচুর বিছানার মাঝখানে। যোগীরও দৃশ্যান্তর ঘটে গেল এরপর। যাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি কখনোই, কোনদিনই। এই যোগী অমৃত লাল ব্রহ্মচারীই নষ্ট করেছিল ইন্দ্রানীকে। যোগী ‘তন্ত্র বলে’- ঈশান নুরকে পাইয়ে দেবে এ আশ্বাসকে বিশ্বেস করেই নিজের দেহ ভাণ্ডটিকে অকাতরে উপায়হীনভাবে মেলে ধরেছিল ইন্দ্রানী যোগীর লোভের আগুনে পুড়ে ছোট হয়ে যাওয়া লাল টকটকে চোখ দুটির সামনে।

‘বুঝলি ইন্দ্রানী’। কিছুটা সাহসে ভর করে এগুবার চেষ্টা করে দুর্গাদাস। ‘তোরে আমি জানতেম, মিছে বইলে আর পাতকি হবার ইচ্ছেও নেই এই বয়েসে আমার। মাঝে মাঝে হোগলার ফুক্রো ফাঁক দে তোরে আমি দেখতেমও। কিন্তু তোরে কিছু বইলবের সাহসটিই আমার হতো নে।’ আর কিছু বলে না দুর্গাদাস। ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে একটি বিড়ি ধরায়।

চুপ করে থাকে ইন্দ্রানী। শুধু চোখের কোলে একটা নেতানো মেয়ে মানুষী ঋতুকালীন সংকীর্ণতায় ঠোঁট দুটি কাঁপতে থাকে, চোখের কোল দুটি চিক্ চিক্ করে ওঠে বুঝিবা। পরমুহূর্তেই ভিজে যায় গাল দুটি। ইন্দ্রানী ভাবতে থাকে অতীত। কিন্তু সে ভাবনা ছাপিয়ে হঠাৎ করেই যেন চলে আসে একেবারে এই মাত্র বাসি হওয়া নতুন স্মৃতির প্রথম পৃষ্ঠায় । নববধূ ইন্দ্রানী। জীবনের প্রথম বিয়ের সলজ্জ কনে। এ সময় ঝগড়া ঝাটি নাকি বড় কুলক্ষণের। দুর্গাদাস কিন্তু থামে না। ইন্দ্রানীর নীরবতায় আরো বেশি করে সাহসী হয়ে ওঠে। অনর্গল অর্গল ভেঙ্গে কথার ইন্দ্রজাল রচনা করে-

‘তা একদিক দিয়ে আমার জইন্যে শুভই হইয়েছে বলতে হবি। ইন্দ্রের জন্যে ইন্দ্র ইন্দ্র বইলে বুক ফাটিয়ে সেই যুদ্ধের ঘোর তা-বের মইধ্যেই একবার মিলিটারি ক্যাম্পে ঢুকতে পারলিই তো আর আইজকের এই বহু কর্ষণে চিড় ধরা জীর্ণ বস্ত্রের মতো দিশী সোমাজতন্ত্রের ক্ষ্যাত হয়ে ফিরতি পারতিসনে। মিলেটেরিরাই তোরে উইদ্ধের কইরে দিতো। সাথে সাথে আমার ইচ্ছের ডগাটিও আর চাক্ষুস তুই পর্যন্ত ঠেকতি পারতো নে।’ একটু থেমে আবার শুরু করে ‘ঈশ্বর মঙ্গলময়, শুন্য কানে আর আঙ্গুল ঠেলতে হবি নে। সাক্ষাত ভগবান নিজেই দূত হইয়ে নিজের হাতে ধইরে এনে সইন্যেসী বাবারে দিয়ে তথাস্তু কইরে তোরে একেবারে আমার কোলের উপ্রে তুইলে দিয়ে গেলেন। নাইলে কোথায় কখন কে শুইনেছে - ডোমের ঘরে কুলিনের ফুল শইয্যে!’

এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে একটু জিরোতে চাইলো দুর্গাদাস। এমনিতেই গঞ্জিকাসেবী তার উপর আবার সুখাদ্যের অভাব। সেই সাথে মাঝে মধ্যেই উপোষের জ্বালা। তার সঙ্গে আবার চিরায়ত দৈহিক উত্তেজনার পীড়ন, অনাচারের মতো প্রাত্যাহিক ব্যাপারগুলি ছায়ার মতো লেগে  থাকা আদিকালের অভ্যেস। রেগে উঠে ইন্দ্রানী ভেতরে ভেতরে অতিমাত্রায়। রক্ত বর্ণে সমস্ত মুখম-ল লালচে হয়ে যায় এবং আরো গভীরতর হতে থাকে। ইন্দ্রানী বোঝে না সমাজতন্ত্র কী? অথচ ঐ একটি মাত্র শব্দতেই বড় ক্ষোভ, বড় ঘৃণা আর অসম্ভব আক্রোশ ইন্দ্রানীর। সাথে আরো বড়ো মাত্রার মিশ্রিত অভিমান। কিছুতেই সহ্য করতে পারে না ইন্দ্রানী। ঐ একটি মাত্র শব্দ ‘সমাজতন্ত্র’। কোন কারণে কেউ কোথাও সে কথা উচ্চারণ করলে আর তা ইন্দ্রানীর শ্রবণ পর্যন্ত কোনক্রমে পৌঁছে গেলে বড় কষ্ট হয় ইন্দ্রানীর। বালির সৌধের মতো বর্তমানটি ওর দরদর করে ভেঙ্গে পড়ে ওর চোখের সামনেই। বড় কাছাকাছি চলে আসে ইন্দ্র, ইন্দ্রের ঘনিষ্ঠ চিনে চিনে উপলব্ধি।

আর সন্ন্যাসী বাবা। গৃহত্যাগী যোগী অমৃতলাল ব্রহ্মচারী। সে তো এক মহাঘোর কৃষ্ণপক্ষের থমথমে মধ্যযামের রতিক্রান্ত অশ্বযুথ। কদাচিৎ আবার যৌগিক প্রতিক্রিয়ায় ঘটে যাওয়া সমুদ্র তলদেশের উত্তাল তা-বের মতো যে তাণ্ডবের বিকীর্ণমান অগ্ন্যুৎপাত আবার শেষ পর্যন্ত প্রশান্ত জলধির উপরিস্তর থেকে স্বভাবতই দৃশ্যমান হয় না জলের প্রতিভায়।
‘মিলিটেরি! ওরে জলধর, ইন্দ্ররে ধইরে নিয়ে নে গেল’। নবদ্বীপ হাট উল্টে দিয়ে লুঙ্গির কাছায় কোমর বেঁধে উঠি পড়ি দৌড় ভেঙ্গে চিৎকার করতে থাকে ইয়াকুব। ওকে অনুসরণ করে জলধর।

‘ওতো ধইরবেই। রাভরা প্যাটে নকল উপোসের ঢংয়ে সোমাজতন্ত্রের ঢ্যঁড়া পিটোলি রাইজ্যের রাজা কি আর ঠিক থাকতি পারে। ইট্টু, আধটু গৌরচন্দ্রিকা তো থাইকবেই। সোমাজতন্ত্র!’ ইয়াকুবের কথার উপর ঘৃণার থু-থু ছিটোয় জলধর। চোখ বুজতেই শশ্মানের নিদারুণ নিস্তব্ধ নিঝুম নবদ্বীপ হাটের হাহাকার। জলাঙ্গী তীরের জীবন জোয়ারও তখন সে হা-হাকারে উল্টে যায়। বাবাও আর দৃশ্য অদৃশ্যের দোলাচলে স্থির অনিশ্চিত ঈশ্বরে ভরসা খুঁজবার মতো সঙ্গত কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না। জাগতিক লোটা কম্বলের প্রয়োজনই প্রত্যক্ষ বাস্তবতা। টোল খেতে খেতে বাবাই সামলে নিলেন ইন্দ্রানীকে। প্রায় মূর্ছা যাবার মতো অবস্থা। এই ‘বাবা’- নামের বস্তুটি হলো সেই যোগী অমৃতলাল ব্রহ্মচারী। প্রায় মুর্ছা যাওয়া ইন্দ্রানীর শরীরি উত্তাপ যেন তার সব যোগীত্বকে নিঃশেষ করে দিলো। পরিবর্তিত করে দিলো এক উচ্চকামী লোভাতুর হিংস্র পাপাত্মায় । নিজেকে উপলব্ধি করবার মতো করে উপলব্ধি করতে চাইলে ইন্দ্রানীকেও। এভাবে হরিদ্রা-বর্ণের এই সুবর্ণ মেখলা যে বড় পিপাসার্ত। ওকে জল পান করানো ব্রহ্মচারীর অবশ্য পলনীয় কর্তব্য। নিজে নিজে আপনা আপনিই বুঝে ফেললেন বাবা। পিপাসার্ত অঙ্গের তৃষ্ণা আত্মাকে যে বড় বিচলিত করে। বড় কষ্ট দেয়। চিন্তান্বিত হলেন বাবা। ঘোর কাটিয়ে অভিভূত। দূর লোকালয়ের ঘন বসতি ভাঙ্গা মরাকান্নার রিনরিনে জোরো প্রলাপ, গাছ গাছালির পত্র পল্লবে ভর করে ক্রমাগত আঁছড়ে পড়তে থাকলো সন্ন্যাসী বাবার শ্রী চরণ যুগলে। হাড়ের ভেতরে সেঁধিয়ে যাওয়া নবদ্বীপ হাটের শ্মশান শূন্য শিরিষ গাছের পাতার শিরশিরে ভয়ের নিঁভাজ ত্রাস। রগে রগে ছত্রাকার। ‘তৃষ্ণায়’ জলপান ঈশ্বরের নির্দেশ’ ফিশফিশিয়ে বলেছিল ব্রক্ষ্মচারী । নিঃশ্বাস ঘন আর ভারী হয়ে এসেছিল ব্রহ্মচারীর । ইন্দ্রানীকে বলেছিল ‘জলপান কর । ঈশ্বরই উদ্ধার কইরবেন।’ আর তারপরই নবদ্বীপ হাটের জনশূন্য একটি পরিত্যাক্ত ভাঙ্গা ঘরের নোংরা আর ঠাণ্ডা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রানীকে সন্ন্যাসী বাবা তার কুলুঙ্গির আশ্রমে।
সেখানেই সন্নেসী বাবার দুটো প্রসারমান শক্ত সমর্থ হাতের এড়ো কব্জিতে বিঁধে গেল ইন্দ্রানী। আত্মহত্যায় নিমগ্ন হলো। ওদিকে হ্র হর কড়্ কড়্ শব্দের বজ্রপাতে ছোট্ট জলাঙ্গীর জলে তুমুল তোলপাড়ের বন্যা বয়ে গেল। নষ্ট হয়ে গেল ইন্দ্রানী।   ------ এরপর যখন বেড়িয়ে এলো বিদ্ধস্ত ইন্দ্রানী সন্ন্যাসী বাবার কুলুঙ্গি আশ্রম থেকে তখন আত্মহত্যার প্রথম সিদ্ধান্তে বড় কঠিন, বড় কঠোর ওর দেহী চৈতন্য। যার তুলনা দ্বীপহীন দ্বীপান্তরের অসার শুন্যতা জড়ানো হাহাকারের অন্য নাম। দৌড়–তে শুরু করলো ইন্দ্রানী আক্রান্ত তাড়নায় আহত লীলাবতীর ঝিলমিল লজ্জ্বা ভেঙ্গে। সামনেই জলাঙ্গীর জল। তরঙ্গে দ্বিতীয় মৃত্যু সন্দেহে মুক্ত। কিন্তু হলো না। চ্যুতি ঘটলো প্রথমবার। সব গোলমাল করে দিল ঈশান নূরের কল্পচিত্র। জলাঙ্গির সব জলে দোলায়মান ওপাড়ের মিলিটারী ক্যাম্প, ওখানেই এখন ঈশান নুর। ইন্দ্রানীর ইন্দ্র, ব্রহ্মা-টা বড় ছোট। ‘ইন্দ্র কি বাঁচবে আর?’ নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো ইন্দ্রানী। তারপর পা বাড়ালো ইন্দ্রানী জলাঙ্গীর ওপাড়ে মিলিটারি ক্যাম্পের দিকে। এতটুকু বিচলন ছাড়াই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারলো না ইন্দ্রানী সেখানে। নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো ইন্দ্রানী। ব্রহ্মচারীই প্রথম নষ্ট করেছিল ওকে। তারপর তুলে দিয়েচিল দুর্গাদাসের হাতে।

‘ইন্দ্র যে আর নেই।’ মাইরে ফেলাবি নে ওরে মিলিটেরিরা। উদ্ধারের পথ!’ তিন কুল শূন্য ইন্দ্রানীর বিলাপ। অনুসন্ধানেই উদ্ধার। ঈশ্বর আদেশ লংঘন করে আমিতো পাতকি হতে পারিনে। নিঃশব্দে একটু হাসে দুর্গাদাস। আরোও একটু ঘনিষ্ঠ হতে চায়। ইন্দ্রানীর দেহভাণ্ডারেই খুঁজে পেতে চায় দুর্গাদাস তার ঈশ্বরকে।

‘বুঝলি তখন মনি হয়তো জীবিতকালে তোর এ কৃষ্ণের শ্যামশোভা দেহভাণ্ডে নিজের স্থান কইরে নেয়া আর তীর্থে ভক্তের মরণে তিল মাত্র ব্যবধান নেই। আর পরকালে? সে তো তোরও জ্ঞান গম্যির মধ্যেই- ডোমের ইচ্ছেয় ঈশ্বরের কানেও আগুনের তাপ উইঠে আসে।’ এবার একটু শব্দ করেই হাসে দুর্গাদাস। হাসির শব্দটায়  একটা ফ্যাঁস ফ্যাঁসে জাতীয় অতি শব্দ ক্রিয়াশীল থাকে শেষ পর্যন্ত। ইন্দ্রানী কিছু বলে না। পায়ের নখে মাটির রক্ত ঝরায়। মিলিয়ে যাবার আগে হাসির সরু লেজটিকে আকড়ে ধরে আবার কিছু বলতে চায় দুর্গাদাস কিন্তু পারে না।  উচ্চারণটিও থেমে যাবার উপক্রম করে। তবুও টেনে টেনে বলে শেষ পর্যন্ত  ‘মাইনি- তুইও যদি কোনোরকমে সেভাবে ইট্টু নষ্ট নষ্ট হইয়ে যেতি পারতিস!’ এই ইন্দ্রানীর নষ্ট হয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষার নেপথ্যে কাজ করে দুর্গাদাসের আর্থিক অসচ্ছলতা। ইন্দ্রানী নষ্ট হয়ে গেলে সে তার দেহটি বিক্রি করে কিছু বাড়তি রোজগার করতে পারতো। ওর আর্থিক সচ্ছলতা প্রাপ্তির সম্ভাবনাটি উজ্বল হয়ে উঠতো। চমকে উঠে তখুনি আবার দীর্ঘদিনের অভ্যাসলব্ধ শক্তি দিয়ে কোনরকমে সামলে ওঠে ইন্দ্রানী। সহ্য করে নেয় শান দেয়া কথার ছুড়ির আঁচড়টিকে। সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে হয়ে যায় উত্তরটাই দিয়ে দেয় যথাযথ-
‘তালি অন্ততঃ মরণ চিতেয় আগুন দেবার শেষ ভরসা একটা জোটানো যায়।’ কিন্তু আর এগুলো না ইন্দ্রানী। জিভটা শামুকের মতো গুটিয়ে নিলো মুখের খোলসে। দাঁতের ধার দিয়ে ঋতুবতী মেয়ে মানুষের নেতানো সংযমিতা দিয়ে নিজের ঠোঁট কাটে। যত কিছুই হোক ইন্দ্রানী আজকে নববধূ। জীবনের প্রথম বিয়ের লজ্জায় লজ্জিত লীলাবতী। এ সময় ঝগড়া ঝাটি করতে চায় না ইন্দ্রানী। এ সময়ে ঝগড়া ঝাটি নাকি আসলেই অলক্ষুণে- আর এটিই সত্য বলে মনে হয় ইন্দ্রানীর কাছে অন্তত এই মুহূর্তে।
কিন্তু দুর্গাদাস জানতো না যে ইন্দ্রানী ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ইন্দ্রানী আর নিজেকে তৈরী করেনি ওর ইন্দ্র ঈশান নুরের জন্যে। ভালবেসেছে কিন্তু কখনোই আর নিজের করে পেতে চায়নি। ইন্দ্রানী বুঝে নিয়েছিল এবং মাঝে মাঝে নিজেই আনমনে ফিসফিস করে উচ্চারণও করতো ‘এই নষ্ট দেহটা দিয়ে তো আর ইন্দ্রের পুজো হবি নে। হে ঈশ্বর ইন্দ্ররে তুমি বাাঁচায়ে রেইখ।’ আর তখনই দুর্গাদাসের কর্কশ কণ্ঠস্বর  শুনতে পায় ইন্দ্রানী। কি যেন বলছে অত্যন্ত ককর্শ কন্ঠে দুর্গাদাস। কিন্তু গ্রাহ্য করলো না ইন্দ্রানী।

০৩. সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা রাজনীতির মর্ম আর অর্থনীতির সূত্র- এসবের কিছুই বোঝে না ইন্দ্রানী, বুঝবার কথাও নয়। শুধু বোঝে যুদ্ধ আর শেখ মুজিব। সবার কাছে যেমন ইন্দ্রানীর কাছেও তেমনি শেখ সাহেব। শেখ সাহেবই যুদ্ধটা বাঁধিয়েছে। নইলে শূন্য থালার নষ্ট এনামেলে উপোসী মুখের ফ্যাকাশে ছায়াতেও ছিল অপার সুখ। রাতের ঘুমে বিঘ্নহীন তৃপ্ততা। তারপরেও অন্তরের অতি নিভৃত কোণে সযতনে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠা করেছিল শেখ সাহেবকে ইন্দ্রানী। বড় ভালো লাগতো মানুষটিকে ইন্দ্রানীর। কেন ভালো লাগতো জানে না ইন্দ্রানী। একেবারে দেবতার মতো। একমাত্র সে-ই তো পারবে এ অভাগা দেশটিকে স্বাধীন করতে। তার মতো মমতার যমুনা আর কেউ নেই যে। আর সে কারণেই মানুষটিকে বড় ভালো লাগত ইন্দ্রানীর। নবদ্বীপ হাটের কোলাহলের চূড়ায় থোকা থোকা জটলার বিদ্বেষের মেলায় ঈশান নুরের ছায়া যখন পরে ইন্দ্রানীর বড় ভালো লাগে দুর্ভিক্ষের হাটে আকালের সন্ধান করতে। ক্লান্তি আসে না, শুধুই ভাবতে ইচ্ছে করে  ইশান নুরকে।  ওর একান্ত নিজের ইন্দ্রকে। ইন্দ্র তো ওরই। শুধু একার ওরই। বুকটা প্রচুর নিঃশ্বাসের জায়গা দিতে পারে না। থিক থিকে স্বপ্নের কাদায় ভরপুর হালকা ফুসফুসের ছোট্ট চত্বর।
লোকে বলে- ‘নির্ঘাৎ নরকবাস’।
‘রাজার বিরুদ্ধে প্রজার আস্ফালন। এ যে বিলক্ষণ লয়ের লক্ষণ।’ জলধরের এই কথাগুলিতে শিরাগুলি টন্ টন্ করে ছিঁড়ে গেলেও ইন্দ্রানী তখন গভীর আত্মমগ্নতায় নিমজ্জিত হয়ে ইন্দ্রের কথায় অবিচল সান্ত¦না খুঁজে পেতে চায়।
‘এ দেশটার কিছু হবিনে রে ইন্দ্রানী। মানুষগুলি সব চামারের পোনা। খালি পাকিস্তানী মিলিটেরীর জুতোর শুকতলা চাইটে, চাইটে নিজেদের ছেরাদ্দ ডেইকে আনে।’
‘চাটবি নে! ভাতই পায় না যে।’ ইন্দ্রানীর নির্লিপ্ত ছোট্ট উত্তর। পেটের নাড়ীতে আকুলি বিকুলি পাক খায়। ঝট্ করে তেঁতে উঠে ঈশান নুর-
‘ভাতের থালা কে কবে কার জিভের ডগায় তুইলে দিয়েছে? ও কাইড়ে নিতে হয়।’
‘শক্তি থাকলিতো!’- খিল খিল হাসিতে ভাংতে থাকে ইন্দ্রানী। ভাংতে ভাংতে একেবারে ঈশান নুরের দেহের সাথে লেপ্টে যায়। আদর করে না ঈশান নুর। চোখের তারা দুটি শুধু অন্তর কাঁপায়।
‘এ সোমাজটারে উল্টোয়ে দিতি হবি রে ইন্দ্রানী। নইলে বাঁচতে পারবিনে। তুইও নে, আমিও নে। ’
আবারও হাসে ইন্দ্রানী।
‘কি যে কও তুমি বকা খাওয়া জোরো রোগীর মতো। মাথার ঘিলু গুলোন সব পইচে গেছে তোমার। এর চে ভাল দেয়ে আমাগের কুনো কাম আছে , না ও আমাগের কপালে সইহ্য হবি?’
অতি ঘোর ক্ষুব্ধ চেতনায় কাঁপতে কাঁপতে ধুক পুক শব্দ তুলে পাকস্থলীর অতল থেকে ফিস ফিস নিস্তরঙ্গ অথচ হড়হড় করে কি যেন একটা বেড়িয়ে আসতে চায় ইন্দ্রানীর গলা ফুটো করে। গলগল করে বমি করে দেয় ইন্দ্রানী ঈশান নুরের পায়ের কাছে। বমি শেষে অসহায়ের মতো তাকায় ঈশান নুরের দিকে অপলক। কিছুটা সময় নিয়ে সামলে নেয় নিজেকে। শাড়ীর আচলের কোনা দিয়ে মুখটা মুছে নেয়। তারপর আবার বলে
‘তার চে চলো একখানা চালা বান্ধি। পায়ে পায়ে টিপে, টিপে আসতিছে তো আর একজন। জায়গা কইরে রাইখতে হবিনে এখুনি?
আচমকা আড়ষ্টতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চায় ঈশান নুর। নিগুঢ় নিস্তব্ধতায় শা- শা সিসে ঢালে দু’কানের দু’পর্দায়। উধাও শব্দের দমকা হাওয়ায় গুড়িয়ে যায় দাঁড়াবার আশ্রয়। অন্ধকারের ডানার নিচে অদৃশ্য হয়ে যায় নবদ্বীপ হাট। ভারী বাতাসে হোঁচট খায় ঈশান নুরের কণ্ঠস্বর।
‘এ সোমাজে নোতুনের জায়গা হয় না রে ইন্দ্রানী। ওর জন্যি চাই আর এক নতুন সোমাজ। হাতুড়ি আর শাবলের আঘাতে আঘাতে ওই সোমাজরে তৈয়ের করতে অয়। আর এই তৈয়ের কইরবের জইন্যে উদোমতন্ত্রের ভারী দরকার হয়। খালি খালি স্বপ্নের মইধ্যে ডুইবে থাকলি কিছুই পাওয়া যাবি নে। এই উদোম গায়ের মানুষ গুলিনরে এক সাথে কইরে, ওদের সব হাত গুলিনরে দিয়ে একটি মাত্র পোক্ত হাত বানাইয়ে সেই হাত দিয়েই হাতুরীর আঘাত কইরে এই সোমাজটি ভাংবার জন্যি  আমাগের শ্যাষ আঘাতটি হানতি হবি। এর বাইরে আর কোনো কতাই নেই যে।’
‘সেইটে আবার কি রকুম সোমাজ?’ ছোট্ট প্রশ্ন ইন্দ্রানীর। ‘সেইটেই তো আসল সোমাজ। যারে বড় বড় বুদ্ধিঅলা লোকেরা কয় ‘সোমাজতন্ত্র’। যে সোমাজে তুমি আমি সবাই সোমান। নোতুন কেউ আসতি চাইলে জায়গা আগেই কইরে রাখা হয়।’ ঈশান নূর ইন্দ্রানীর কথার জবাব এভাবেই দেয়।
‘তালি সোমাজতন্ত্রের সেই দুনিয়াটি তোমার বানাতিছোনা কেন? সেটি হলি তো এই হা-ভাত আর যম-ভাত থাকে না।’
‘সেই চেষ্টাই তো তলে তলে আমরা সব্বাই কইরতেছি। সেইটের জন্যেই তো আইজকের এই যুদ্ধ। এত রক্তের ধারা। শোন যত দিন আমরা সেই সোমাজরে বানাতি পারবো নে তত দিনের আগে কোনো নতুন অতিথিরে দুইন্যায় আসতে দেয়া যাবি নে।’ ঈশান নুরের কথায় প্রতারনার ইঙ্গিত স্পষ্ট। কিন্তু বুঝতে পারে না ইন্দ্রানী। ইন্দ্রানী শুধু বলে ‘তালি এখন কী হবি?’ প্রশ্ন করে ইন্দ্রানী।
‘ কিছুই হবি নে। ওরে নষ্ট কইরে ফেলতি হবি।’
আঁতকে উঠে ইন্দ্রানী-
‘কি কও ? আমি বাঁচবো কেমন কইরে?
‘ক্যান? আমারে নিয়ে। যারে এই সোমাজে জায়গা দিতি পারবিনে তারে আইনে কি করবি? তার চে মমতা জাগানের আগেই নষ্ট কইরে ফালানেই কি ঠিক না? যদি কুনক্রমে একবার সোমাজতন্ত্রটিরে আনতি পারি তালিতো আর অভাব বইলে কিছু থাকবি নে। তখন তো একটি ক্যান পাঁচটি আসলিও বাঁচায়ে রাখতি পারবি তুই।’ নিরুপায় হয়ে ঈশান নুরের এ কথাটিকে বিস্বাস করতে চায় ইন্দ্রানী।
‘সত্যই, সত্যি কথা বইলতিছো?’
‘ক্যান, আমার ভালোবাসায় তোর বিশ্বেসের অভাব আছে?’ -দৃঢ়তায় ভরপুর ঈশান নুরের পাল্টা প্রশ্ন।
এ কথা শুনবার পর ঈশান নুরের বুকেই মুখ লুকিয়েছিল ইন্দ্রানী। অনেক আদর করেছিল ঈশান নুর ইন্দ্রানীকে। সেদিনই নিধু কবরেজের কাছ থেকে ছ’টাকা পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে ওষুধ এনে নষ্ট করে দিয়েছিল ওর পেটের সন্তানকে। এর পর অনেকদিন প্রচণ্ড কষ্ট করেছিল পেটের সন্তানকে মা হয়ে নিজেই ওর জন্মাবার আগে নিজেই হত্যা করে। অনুতাপ অনুশোচনায় প্রচণ্ড দগ্ধ হতে হতে যেন প্রাণহীন হয়ে গিয়েছিলো ইন্দ্রানী। সন্তানটিকে নষ্ট করবার সময় ঔষধি ক্রিয়ায় রক্ত ক্ষরণ হয়েছিল অপরিমিত। সে সময় প্রচুর সাহায্য করেছিল ঈশান নুর। সব সময় কাছে কাছে থেকে ছিল ইন্দ্রানীর। দুজনের ভালোবাসা আরও গভীর থেকে গভীরতর হয়েছিল ওদের মধ্যে। ঈশান নুরের বলা- ‘সোমাজতন্ত্র’- কে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছিল ইন্দ্রানী।
এরপর ঈশান নুরের ঐ উদোমতন্ত্রের শ্রুতিটিই লোকে, লোকে, কালে, কালে ধাবিত হয়ে সমাজতন্ত্র নামের দু’বেলা পেটপুরে খাবার বর্ণিল বস্তুটি নবদ্বীপ হাটের উপোসি মানুষগুলির কাছে বহু বিস্তারে বর্ণিত হয়ে গিয়েছিল বিচিত্র পথে। লোকে জানত এবং বিশ্বাস করতো ঈশার নুর সমাজতন্ত্রের মানুষ। মাটির নিচে ওর সব কাজ কারবার। ঈশান নুরের কথাতেই এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে  আসা ইন্দ্রানী ওর সমাজতন্ত্রের প্রখর উদ্দীপনা। দেশটা এবার আর উদ্ধার না হয়ে যাবে না কিছুতেই। এরই ধারাবাহিকতায় বোধকরি মাঝে মধ্যে কিল বিল করে তেড়ে আসতো উদোম গায়ের খুচরো ছেলে ছোকড়াদের চিৎকার করা মিছিল। ভাঙ্গাচোরা ফেস্টুন, উচ্ছ্বাস আর অস্থির কোলাহলে কিম্ভুতকিমাকার হয়ে যেতো সব কিছু। এত ভারী দুঃখ পাবার পরেও হাসির বুদ্বুদ ওঠতো ইন্দ্রানীর তলপেট মুচড়ে দিয়ে।
‘উদোম তন্ত্রের শাস্ত্রী সেপাইদের উপোসের কাল এইবার কাটাইল বইলে।’ তিতেটে ঢেকুর গিলেও অঘ্রানের বিকেলের এক  ফোটা রোদের অনিবার্য একটি ‘সুখবৃত্ত’- রচনা করতো ইন্দ্রানীর একরত্তি চোখের তিরতিরে দুটি কৃষ্ণকালো  উজ্জ্বল তারায়। ঈশান নুর তো এ তন্ত্রেরই নেতা। পরপরই নিজের ভেতর কেন জানি আবার আতঙ্কের উতুঙ্গ বিবমিষা আলোড়ন তুলতো । অলক্ষুণে একাত্তরটা যদি সকালের আগেই বেঘোরে নিপাত যেতি পারতো !‘আবার নিষ্প্রাণ হয়ে যায় ইন্দ্রানী। উজ্জ্বল কালো চোখের তারা দুটি থেকে এক এক করে সব আকাক্সক্ষার আলো আবার নিভে যেতে শুরু করতো।

অবোধ্য, অসম্পূর্ণ বিশাল বোধের চরাচরে একটি ছিদ্রহীন সম্পূর্ণতা যেন নির্জন নিশ্চেতনতার গহীন গাঙ্গে চেতনার সুতো কাটে- নোংরা গোবরে পোকার চির্-র্, চির্-র্- শব্দ তুলে। পাজরের নীচে আকণ্ঠ নিমজ্জমান ধুকধুকে হৃৎপিণ্ডটি শ্বাসকষ্টে চিড়ে চিড়ে যায় বেধড়ক কুঁড়ে যাওয়া বিশ্রী শব্দের ঘুর্ণিপাকে নীলাভ কুয়াশার ছড়ানো ধোঁয়া আর সেই নীল আগুনের মিহি শিখার ডিগবাজীর শব্দে ডুবতেই থাকে ইন্দ্রানী অজ্ঞাত এক আশঙ্কার খণ্ড খণ্ড ঝোপঝাড় দুমড়ে মুচরে দিয়ে। নবদ্বীপ হাট দোল খায় আকাশচারী মুলি বাঁশের সরু কঞ্চির ডগায়। উৎরাই ভাঙ্গা বাঁধের চিক চিকে বালির জ্যোৎস্নার অন্ধকার থমকে দাঁড়ায়। চকচকে বর্ষার তীক্ষ্ণ ফলায় ঈশান নুরের চারকোণে মাথাটা গোটা চরাচরকে একাকার করে ফেলে। প্রহর ঘোঘণায় উচ্চকিত শেয়াল কুলের একত্রিত অবিরাম শব্দবান হুড়মুড় ধাক্কা খেয়ে ডানা মেলে দেয় যেন আরও দূর, বহুদূর শুন্যালোকের জমাট বাধা অখণ্ড নিস্তব্ধতায় । কিন্তু পরক্ষণেই আবার সে নিস্তব্ধতার চির ধরা ফাটল থেকে তাড়িত হয়ে সেই নীল আগুনের মিহি শিখা মাটির ওপরের সবুজ ঘাসের আকাশমুখী ডগায় নীল আগুনের ফুলকি হয়ে সে মিহি শিখা আর নীল কুয়াশার ফেনিল বুব্ধুদ ঢেউহীন সমুদ্রের প্রশান্ত জলের মতো নিঃসীম চেতনাহীনতার ডিঙ্গিতে আশ্রয় খোঁজে।

‘বাতাসের তোড়ে সব থেইমে গেল ক্যান্? কইলজের ভেতরটি ফাইটে যায় যে।’ নিজেকে প্রশ্ন করে কোন উত্তরই খুঁজে পায় না ইন্দ্রানী। নীল কুয়াশার ছোপ ছোপ ফেনা আর নীল আগুনের মিহি শিখার মুখোমুখি ডিগবাজীতে - সমাজতন্ত্রের ক্ষরিত রক্তে ভাসতে থাকে ইন্দ্রানীর সুখ আর সুখের সব অলীক কল্পনা। ইন্দ্রানীর অন্তরটি হয়ে যায় ক্ষোভ আর অভিমান মিশ্রিত ঘৃণার ভাগাড়।
বুদ্ধির ঝিল্লিপুঞ্জে পাক খেতে খেতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় চৈতন্যের ধবল লাশ। অপসৃয়মান প্রকৃতির জন্মাদ্ধ বস্তনিচয়ের প্রগাড় উৎকণ্ঠায় ঠুকে গিয়ে চুরমার হয়ে যায় মিলিটেরি ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে হঠাৎ করেই নবদ্বীপ হাটের চেয়ারম্যান হয়ে যাওয়া ইন্দ্রানীর আজন্ম লালিত স্বপ্ন, ইন্দ্রানীর একান্তই আপনার ইন্দ্র- রাজাকার ঈশান নুর। এই কি সেই ঈশান নুর। নাকি ঈষান নুরের অবাস্তব বীভৎস, বিকৃত প্রতিমূর্তি ঈশান নুরের ছায়ার জান্তব শরীর। রাজাকার ঈশান নুরের সমাজতন্ত্রী রাজনীতির আধ্ম্যতিক উচ্চারণ ‘সমাজতন্ত্রে ঈশ্বর নেই। ঈশ্বরে নিজেরে সমর্পণ কর। উইদ্ধের তিনিই কইরবেন।’

ইন্দ্রানীকে গ্রহণ করতে চেয়ারম্যান ঈশান নুরের সরাসরি অস্বীকৃতি। দ্রুত পায়ে দৌড়ে কোনোরকমে পালিয়ে এসেছিল ইন্দ্রানী ঈশান নুরের সামনে থেকে। সোজা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল চিৎ হয়ে। হোগলার চালার অসংখ্য  ফুটোয় আটকে গিয়েছিল টুকরো টুকরো অসংখ্য ঈশান নুর। সংখ্যাতীত বুক চেরা আকুলি বিকুলি ইন্দ্রানীর বার বার এ টুকরোগুলির সাথে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল ইন্দ্রানীর কাছেই। উত্তর যা পেয়েছিল তাতে অবশিষ্ট আর কিছুই ছিল না। সব শুন্য হয়ে গিয়েছিল। কেমন একটা চরম অবজ্ঞার চাকচিক্য ঝলসে উঠেছিল ঈশান নুরের ঐ উত্তরের সবটা জুড়ে।

ইন্দ্রানী আশ্চর্য হয় না। রাজাকার চেয়ারম্যান এ ঈশান নুর তো তার সেই সমাজতন্ত্রী ইশান নুর নয়। এ ইশান নুর তো পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যদের সাক্ষাৎ প্রেতাত্মা। অথচ এই ইশান নুরের সমাজতন্ত্রের আওড়ানো বুলিতে বিশ্বাস স্থাপন করে নিজেই হয়ে গিয়েছিল ইশান-নুর কথিত সমাজতন্ত্রের চরম শিকার। ‘সোমাজতন্ত্রে  সকলের অধিকার সোমান’- ইশান নুরের এই কথাটির সত্যতা খুঁজে পেয়েছিল ইন্দ্রানী শুধু মাত্র তার শরীরটির উপর ভোগ করবার সকলের অধিকার সমানভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রটিতে। আর কোথাও নয়। সবশেষে আশ্চর্যতম বিষয় নবদ্বীপ হাটের উদোমতন্ত্রী হাজার হাজার উপোসী মানুষের জমাটবদ্ধ শ্লোগানের তীব্র চিৎকার আর তাদের হাতে রক্ষিত তীক্ষ্ণ বর্ষা ফলায় আমুল বিদ্ধ ইশান নুরের নিষ্প্রাণ দেহটা খুব কাছাকাছি থেকে দেখেছিল ইন্দ্রানী। চিৎকার করে ওঠেনি ইন্দ্রানী, কাঁদেও নি শব্দ করে। শুধু দু,ফোটা করুণার অশ্রু ঝরে পড়েছিল ওর দু’চোখের কোণ্ বেয়ে। এই হাজার হাজার উপোসী মানুষের জমাট বাঁধা শ্লোগানের চিৎকারে ইন্দ্রানীর অতি তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরটি শুধু হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হারিয়ে যায় নি ওরও হাতে রক্ষিত অতি ক্ষুদ্র বর্শাটির তীক্ষ্ণ ফলাটি।

পরদিন দেখেছিল ইন্দ্রানী জলাঙ্গির তীরের বালু চরের জ্যোৎস্নার চিকচিকে বালির গভীরে অর্ধেক সেঁধিয়ে যাওয়া ঈশান নুরের চারকোণে মাথাটি। আর সেই নীল কুয়াশার ছোপ ছোপ ফেনিল বুদ্বুদ আর নীল আগুনের মিহি শিখার একত্রিত প্রচণ্ড উল্লাস। ক্রমান্বয়ে কুয়াশার সেই নীল রং আর নীল আগুনের মিহি শিখা শূন্যলোকের অসীম স্বাভাবিক নীলের সাথে আরও নীলাভ হয়ে যেতে থাকলো।
জোড়া লাগা ঠোঁটের রেখায় ঝড় ওঠে ইন্দ্রানীর। ছিড়ে যায় অতি মসৃণ আর পাতলা ঠোঁটের পরত।  ফিস্ ফিস্ করে শব্দ হয় ঠোঁটের চড়ায়। সেই পুরনো শব্দ ‘তালি আমি একাই  সোমাজতন্ত্রের ক্ষ্যাত হইয়ে গেলাম ক্যান?’ উত্তর বিহীন বিশাল প্রশ্ন। কে দেবে এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর? এমেন আছে কি কেউ? না, নেই একমাত্র ঈশান নুর ছাড়া। কিন্তু সে তো এ প্রশ্নের সঠিক উত্তরটি দেবে না।

০৪.
আত্মহত্যা করা হয় না ইন্দ্রানীর।  ডুবতে থাকে সেই ছোপ ছোপ নীল কুয়াশার অসংখ্য বুদ্বুদের অতলান্ত থেকে অতলান্তে। ‘ইন্দ্রানীরে মিলিটেরিরা আমার দুই চোখ খুইলে দে গেছে। মিলিটেরি ক্যাম্প থেকে ওদের দেয়া রাইফেলটিসহ রাজাকার হইয়ে না ফিরলি আজ আমি কি আর নবদ্বীপহাটের চিয়েরম্যান হতি পারতেম? কিন্তু তুই যে একেবারে পুরোটাই ‘কমুনিস্টোর’ ধ্বজা উড়োয়ে দিলি। আমি অনেক ভেইবে দেইখেছি ও বড়ই স্যাতস্যাতি। তাই আর ভিজে কাঁথা গায়ে জড়াতে চাই নি। সোজাসুজি রাজাকার হইয়ে ফিরে এইসে এই নবদ্বীপ হাটের চিয়েরম্যান হইয়েছি। আসলে নবদ্বীপ হাটের মানুষগুলি বড় বেশি ভালো। আমারে ঠিকই চিইনে নিইছিল। তা না হলি আমারে কি আর রাজাকার জাইনেও এই নবদ্বীপ হাটের চিয়োরম্যান বানাতো?’ ঈশান নুরের আত্ম-অহংকারের বিকট প্রকাশ।
এতগুলি কথার উত্তরে ইন্দ্রানী শুধুমাত্র দুটি প্রশ্ন করেছিল-
‘তালি আমারে তুমি ‘সোমাজতন্ত্রের’ ক্ষ্যাত বানাইলে ক্যান? ক্যান আমি সোমাজতন্ত্রের ক্ষ্যাত  হইয়ে গেলাম?’ উত্তর শোনার জন্যে আর দাঁড়ায় নি ইন্দ্রানী। শুধু নিজের দুটি হাতের তালুর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ, দেখছিল হাত দুটির তালুতে, আঙ্গুলের ডগায় আর নখের গভীরে রক্তের ছোপ এখনও লেগে আছে কি না। এরপর এক অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছিল ইন্দ্রানী। যেন অনন্তকালের এ যাত্রা। যার কোন শেষ নেই। চলতেই থাকবে ইন্দ্রানীর প্রতিহিংসা আর আত্মহননের অভিলাষের ওপর আত্ম-প্রতিষ্ঠার অহংকারের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে আপন অন্তর্লোকে অন্তর্গত হয়ে অবিশ্রান্ত। অপার মহাশূন্যের সীমা ছড়িয়ে যাওয়া অসীমতার কোন শেষ নেই যে। প্রকৃতই আছে কি? নেই। আর এই-ই তো স্বাধীনতা।

0 comments: