গল্পটি যা বলার তা বলেছে - অনুবাদ: সুশান্ত বর্মন

গল্পটি যা বলার তা বলেছে - অনুবাদ: সুশান্ত বর্মন
জন্মেছিলেন ইরানে। ১৯১৯ সালের ২২ অক্টোবর। জিম্বাবুয়েতে পিতার খামারে কেটেছে সবুজ শৈশব। বিস্তীর্ণ প্রান্তর শিশু ডরিসকে নৈঃসঙ্গের সৌন্দর্য চিনিয়েছে। বিশাল দিগন্ত সম্প্রসারিত করেছে মনের জানালা। বাকী জীবনে ডরিস লেসিং এই ঔদার্য দিয়েই চিনেছেন পৃথিবীকে। প্রথম উপন্যাস ‘দ্যা গ্রাস ইজ সিঙ্গিং’ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে চারপাশে সাড়া পড়ে যায়। বর্ণবাদ এবং এ প্রেক্ষাপটে মানুষের মানবীয় সম্পর্কের টানাপোড়েন উপন্যাসের মূল বিষয়। ফলে ১৯৫৬ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ডরিস লেসিং নিষিদ্ধ হয়ে যান। একসময় কমিউনিজম তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং বাস্তব সমাজ তাঁকে হতাশ করে। তিনি আসলে তথাকথিত আদর্শনির্ভর জীবন যাপন করতে চাননি। ধর্মীয় চিন্তা, কমিউনিজম ইত্যাদি তাঁর কাছে ডগমা নির্ভরতা বলে মনে হয়। তিনি যে কোন রকমের ডগমার কাছে আত্মসমর্পণকে ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করেন। বস্তুত কোন কিছুর অবিনশ্বরতায় তাঁর বিশ্বাস নেই। যুদ্ধ তাকে সবসময় পীড়া দেয়। তিনি বলেন “প্রথম মহাযুদ্ধ আমাদেরকে মনুষ্যত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমাদের নীতিবোধকে ধ্বংস করেছে, আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। আমরা দিনে দিনে অমানবিক হয়ে যাচ্ছি।” ডরিস লেসিং এর লেখায় এর সবকিছুই এসেছে সমান্তরালভাবে। জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তাঁকে নারীবাদী হতে দেয়নি। বরং তিনি নারীবাদীদের নিয়ে সবসময় মশকরা করেছেন। তিনি বরং বলেন “আমাকে জড়িয়ে যেসব নারীবাদী বিশেষণ দেয়া হয় তার সবগুলোই মিথ্যা।” ডরিস লেসিং লিখতে বেশ পছন্দ করেন। নির্জনতা তাঁকে খুব টানে। পৃথিবীব্যাপী ঘুরে বেড়াবার একাধিক প্রস্তাব তিনি অবহেলায় ফিরিয়ে দেন। তিনি বলেন “ঘুরতে ভালো লাগেনা। তার চেয়ে এই সময়ে বাসায় বসে আর একটি বই লিখে ফেলি।” আটাশিতম জন্মদিনের মাত্র এগারোদিন আগে তাঁর নাম নোবেল পুরস্কার ২০০৭ এর জন্য ঘোষিত হয়। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। সেসময় তিনি অসুস্থ পুত্রকে হাসপাতালে দেখে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ির সামনে মিডিয়ার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে তিনি যখন ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেন তখনই টেলিফোনে নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়। আট মিনিটের এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন অ্যাডাম স্মিথ।

ড. লে: হ্যালো।
অ্যা. স্মি: শুভ সকাল। আমি কি ডরিস লেসিংয়ের সাথে কথা বলতে পারি?
ড. লে: কে বলছেন?
অ্যা. স্মি: নোবেল ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট থেকে আমি অ্যাডাম স্মিথ বলছি। সংরক্ষণে রাখার জন্য আমরা ঐতিহ্যগতভাবে নতুন লরিয়েটদের একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার টেলিফোনে নিয়ে থাকি। আশা করি এই আলোচনার জন্য খুব অল্প কয়েক মিনিট আমরা ব্যয় করবো।
ড. লে: আচ্ছা। তারপর?
অ্যা. স্মি: সত্যিই আপনাকে অনেক অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ।
ড. লে: ধন্যবাদ।
অ্যা. স্মি: সুইডিশ একাডেমীর প্রতিবেদনটি কি আপনি দেখার সময় পেয়েছেন?
ড. লে: না, আসলেই না। আমি এখনও দেখিনি। আপনি জানেন আমি এই দুপুরে আমার ছেলেকে হাসপাতালে রেখে এলাম। আমি ছাপানো কোন কিছু এখনও দেখিনি। আর…. নোবেল কমিটির সচিবের সাথে অবশ্য আমার আগে কথা হয়েছিল।
অ্যা. স্মি: তার মানে আপনি হোরেস ইঙ্গডাহল এর সাথে কথা বলেছেন?
ড. লে: হ্যাঁ।
অ্যা. স্মি: তাঁদের প্রতিবেদনে আপনার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, "আপনি নারী বিষয়ক অভিজ্ঞতার মহাকাব্যিক লেখক, যিনি সংশয়বাদ, জ্বালাময়ী শক্তি ও দূরদৃষ্টি দিয়ে বিভক্ত সভ্যতাকে নিরীক্ষার জন্য বিষয়ভূক্ত করেছেন।" আপনি কি মনে করেন এই বিশেষণগুলি আপনি যা লিখেছেন তার অন্তত: কাছাকাছি গিয়েছে?
ড. লে: আমি ঠিক জানিনা, যখন তারা এমন লিখেছে তখন তাদের মনে কি ছিল? কিন্তু দেখুন আমার মনে হয় তারা বিষয় বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বিপুল পরিমাণের লেখার মুখোমুখি হয়েছিল। আপনি কি মনে করেননা যে, এর সবগুলোকে মিলিয়ে সারাংশ করা বেশ কষ্টের?
অ্যা. স্মি: হ্যাঁ, তাতো বটেই।
ড. লে: এত সহজ নয়।
অ্যা. স্মি: তা ঠিক। ৫০টির বেশি বই এবং বহুমুখী বৈশিষ্ট্যের লেখার সংমিশ্রণ আপনার সম্পর্কে বর্ণনাকে কিছুটা অসাধ্য করে তোলে। হ্যাঁ তাই। আচ্ছা, যখন লেখেন তখন গল্পটি বলার চেয়ে কোন একটি উদ্দেশ্য আপনার মাথায় থাকে এমনটা কি আপনি মনে করেন?
ড. লে: অবশ্যই না। কারন মনে রাখবেন আমি একসময় কমুনিস্ট ছিলাম এবং মানুষের মনের কারিগর হিসেবে লেখকদের বেশ কিছু নোংরা উদাহরণ আমাদের আছে। আমাদের যে কাউকে ভীত করে তোলার জন্য এটা যথেষ্ট। আপনি জানেন আমি সেই প্রজন্মেরই একজন।
অ্যা. স্মি: তাহলে আপনার লেখায় উদ্দেশ্যমূলক কিছু খোঁজার ভার কি পাঠকদের উপরে দিতে চান?
ড. লে: আপনি জানেন পাঠকরা যে কোনভাবেই এটা করে। পাঠক তার নিজের মন নিজেই তৈরি করে নেয়। লেখক শুধু তাকে সঙ্গ দেয়। সেখানে আপনার করার কিছুই নেই। বস্তুত: আপনার লেখার ভুল ব্যাখ্যাও তারা করতে পারে। কিন্তু আপনি এমনটা বলতে পারেননা যে-”ওহ না! এধরণের বর্ণনা আদৌ ঠিক নয়। আমি যা বোঝাতে চেয়েছি তা অন্যকিছু।” আপনি লিখবেন এবং পাঠকরা যা চায় তা তাদের প্রত্যাশার উপরে ছেড়ে দিন।
অ্যা. স্মি: এবং এভাবে, তাদের জন্য…. অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি অগণিত পাঠককে আপনার লেখনীর কাছে নিয়ে আসতে উৎসাহিত করবে। যারা আপনার লেখা পড়েনি তাদেরকে শুরুর জায়গাটি বলবেন কি?
ড. লে: হয়তো অবাক হবেন তারপরও শুধুমাত্র তরুণরা পছন্দ করবে বলেই একটা বিষয় আপনাকে জানাই। এটা ’ফিফথ চাইল্ড’ সম্পর্কে। আমি বিস্মিত যে, অল্প বয়সীরা এটাকে পছন্দ করে। অতএব তারা এটা দিয়ে শুরু করতে পারে এবং নিজেদের কার্যকলাপ বুঝতে পারবে। আমি ‘মেরা ও ড্যান’ নামে একটি রহস্যগল্প লিখেছিলাম। যেটা তরুণদের পছন্দ বলে আমি জানি। এ সম্পর্কে…. এরপর আমার প্রথম উপন্যাস ‘দ্যা গ্রাস ইজ সিঙ্গিং’ এখনও কত জীবন্ত। তারা শুরু করার জন্য এটাকেও বেছে নিতে পারে।
অ্যা. স্মি: আপনার সৃজনশীলতা অবশ্যই বিস্ময়কর এবং আমার ধারণা কেউ কেউ অবাক হবে এটা ভেবে যে এত সাহিত্যকীর্তিকে আপনি কিভাবে সামলান। এটা কি এজন্যই যে আপনার মধ্যে অবিরাম কাজপাগলামোর একটি ঝোঁক রয়েছে? আপনার মনে অনেক গল্প বলার জন্য অপেক্ষা করছে? কোনটা এটাকে সচল রাখে?
ড. লে: আচ্ছা, এটা অবশ্যই সত্য যে, আমার একটা…, লেখালেখি বিষয়ে আমি নিজেই নিজেকে পরিচালিত করে। আপনি জানেন আমি এটা ছাড়া আর কিছু করিনা। আমি খুব একটা সামাজিক নই এবং আমি আমার পরিপার্শ্ব দ্বারা এমনভাবে বেষ্টিত যে আমাকে দিয়ে তারা লিখিয়ে নেয়। আপনি জানেন যদিও আমি সামাজিক ছিলামনা (আমি প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক মানুষ), কিন্তু তারপরও আমার ধারণা…. আমি যেটা ভাল পারি সেই আনন্দের জন্য জীবনকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করতে পারি।
অ্যা. স্মি: তাহলে এটা কি স্বআরোপিত নির্বাসন? অথবা এটা কি শুধুই সৃষ্টিশীলতা, যা অধিক সম্ভাবনাময় হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করে?
ড. লে: আসলে এটা সেটাই যা আমি নিজে করি। আমি প্রাকৃতিকভাবেই এটা করি। সবসময়, আমি সবসময় এখন কি লিখছি তা নিয়ে চিন্তা করি। কিন্তু আপনি জানেন আমার নানারকমের শখ নেই। এটাকেও সেরকম ভাবুন। একমাত্র বা অন্য কারণ হিসেবেও।
অ্যা. স্মি: গতকাল টেলিভিশনে আপনার প্রতিক্রিয়া দেখে যে কেউ প্রশ্নটির উত্তর আন্দাজ করতে পারবে। কিন্তু নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাব্যতার বিষয়ে কিছু বলুন।
ড. লে: ওহ সেটা ভাববেন না। আপনি জানেন, সাধারণত ২/১ মাসের মধ্যেই মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তারা সাক্ষাৎকারের জন্য চাতকের মতো অপেক্ষা করেনা। আর আমার অতো সময় নেই, আপনি জানেন এত কিছুর জন্য আমার অতো সময় নেই। তাই সমস্যাকে তার নিজেকেই সমাধান করতে হবে।
অ্যা. স্মি: আর একটি প্রশ্ন, আপনার রচনাশৈলীর পরিসীমা সম্পর্কে কিছু বলুন। সম্ভবত: কবিতা ছাড়া আপনি প্রায় সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এই যূথবদ্ধতা কি আপনি সচেতনভাবে বেছে নেননি? অথবা এটা নিজেকে প্রকাশ করার কিছু প্রয়োজনীয় ফর্ম মাত্র।
ড. লে: না, একসময় আমার এটা আইডিয়া, একটি গল্প অথবা কিছু একটা আমার মাথায় ছিল। তারপর এটা নিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে চাইল। আপনি জানেন, “ওহ, আমি একটি, জানিনা কি, একটি ৫০,০০০ শব্দের বাস্তববাদী বই লিখতে যাচ্ছি” - এরকমটা আমি কখনই বলবনা। তারপর যা ঘটল তা হল বইটি, গল্পটিতে আমি যা বলতে চেয়েছি তাই বর্ণনা করে। যেভাবে বলার ছিল সেভাবেই বলে। এজন্য বিভিন্ন ভঙ্গীতে আমাকে লিখতে হয়। যদি আপনি এভাবে তা বলতে চান তা পারেন, কারণ আমি সত্যি বিভিন্ন বিষয়ে গল্প লিখেছি। এটা অথবা সেটা পড়তে চাওয়ার প্রশ্ন এটা নয়। আমি মনে করি যখন আমি ‘সিকাস্তা’ ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করলাম, যেটা লক্ষ বছর পরিসীমার, এর ঘটনাগুলো নিজেই নিজেকে এক একটা ভঙ্গীতে উপস্থাপন করে। আপনি আসলে এভাবে শুরু করতে পারেননা, “ওহ, আচ্ছা, জো ব্লগ তার রান্নাঘরে বসেছিল এবং এক কাপ ‘টাইকু চা’ পান করল, এবং তার শ্যালিকাকে একটি চিঠি লিখল।” এটা ভিন্নভাবে বলার একটি পদ্ধতি আপনার থাকতে হবে। আসলে এটাই আমার বিষয়বৈচিত্র্যের মূল উৎস।
অ্যা. স্মি: হ্যাঁ, অপ্রচলিত পদ্ধতিকে আপনি আত্মস্থ করতে পেরেছেন এটা বুঝতে সুইডিশ একাডেমী অনেক লম্বা সময় নিয়ে ফেলেছে।
ড. লে: এ বিষয়ে আমার ধারণা, সম্ভবত, বিজ্ঞান কল্পকাহিনীকে নোবেল কমিটির লোকজন অতটা পছন্দ করেনা। এর মানে, আমার ধারণা তারা এর খুবই ভুল ব্যাখ্যা করেছে। হয়তো এখন তারা এটা সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছে। যেমন উদাহরণস্বরূপ ‘মেমোরীজ অব এ সারভাইভার’, অথবা ‘ব্রিফিং ফর এ ডিসেন্ট ইনটু হেল’। এগুলো শ্রেণীবদ্ধ করা বেশ কঠিন। হয়তো এটা তাদের জন্যও কঠিন ছিল।
অ্যা. স্মি: আচ্ছা, মনে হচ্ছে নোবেল কমিটির পছন্দ অনেককে আনন্দিত করেছে। গতকাল হোরেস ইঙ্গডাহল যখন আপনার নাম ঘোষণা করছিলেন তখন অসংখ্য প্রশংসা ঝরে পড়ছিল।
ড. লে: ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।
অ্যা. স্মি: আমাদের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এই ডিসেম্বরে যখন আপনি পুরস্কার নেয়ার জন্য স্টকহোমে আসবেন আমার ধারণা হোরেস ইঙ্গডাহল আপনার একটি লম্বা সাক্ষাৎকার নেবেন। ততোদিন পর্যন্ত আপনার অপেক্ষায় রইলাম।
ড. লে: আপনার দেখা পাবো আশা রাখি। ধন্যবাদ।
অ্যা. স্মি: আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ড. লে: বাই
অ্যা. স্মি: বাই বাই।

0 comments: