নিশান | রানা ভিক্ষু

নিশান | রানা ভিক্ষু

শহরে এসে খাবার হোটেলে মেসিয়ারের কাজ পেয়েছে হামিদ। এটো টেবিল মোছা তার কাজ। সকাল থেকে রাত দাঁড়াবার জো নাই। প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠতে হয়। পরাটার জন্য বানানো ডাল দিয়ে গরম ভাত, এই হলো প্রতিদিনের সকালের নাস্তা। ভাতের সাথে মাছ ও মাংসের জন্য বানানো কৃত্রিম ঝোলের সাথে সবজি অথবা ভুনা ডিম দিয়ে দুপুরের খাবার। আর বেশিরভাগ রাতে খাওয়ার রুচিই থাকে না হামিদের। মধ্যরাতে হোটেলের সাঁটার বন্ধ করা হলে পেট ভরা গ্যাসের ঢেকুর তুলতে তুলতে হামিদ ঘুুমাতে যায় টেবিল জোড়া লাগিয়ে। এই খাওয়া ও থাকার খরচ কেটে নিয়ে মাসে সাতশ’ টাকা বেতন পায় হামিদ।

শুধু হামিদ নয়, সেকেন্দার, রব্বানী, কালু, জাহাঙ্গীর, কেকারু মিলে পাঁচজন হোটেলেই রাত কাটায়। তবে সব থেকে জুনিয়র হামিদ। হামিদ যেদিন এখানে কাজ শুরু করেছে তার ক’দিন পরেই অদ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটলো তার স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবনে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে কয়েকজন এসে প্রত্যেককে একটি করে সাদা গেঞ্জি আর একটি করে লাল ‘নিশান’ দিল। বলল- এগুলো পরে কাল মিছিলে যেতে হবে। দুপুরে আলোচনা সভা হবে, সভা শেষে গান। সভায় বক্তৃতা দিতে ঢাকা থেকে কে যেন আসবেন, অতিথির নাম-পদবি গেঞ্জি ও নিশান বিতরণকারী লোকগুলোও জানে না। সবার কাছ থেকে চাঁদা ধরা হলো পঞ্চাশ টাকা। হোটেল মালিক চাঁদা পরিশোধ করে দিল, সবার বেতন থেকে কেটে রাখার শর্তে।

হামিদ জানে না কিসের মিছিল। ওদের মধ্যে কালু স্কুলে পড়েছিল। গেঞ্জির বুকে লাল রঙে লেখা ‘মহান মে দিবস’ কথাটি তার মুখেই শুনলো হামিদ। কথাটির অর্থ কী, কেন মিছিল, কেন গান এসবেব কিছুই জানে না সে। অন্যদের কাছে যা শুনল তার সারমর্ম হলো- ‘এদিন বেশ আনন্দ হয়। সাদা-গেঞ্জি আর লাল-নিশান পাওয়া যায়। ট্রাকে তুলে মিছিল করতে করতে নিয়ে যায় আলোচনাসভায়। সভা শেষ হলে খিঁচুরি খাওয়ায়। সন্ধ্যায় হয় গান। এদিন কোনো কাজ করতে হয় না।’

এসবের কোনো কিছুই অর্থবহ হলো না হামিদের কাছে। গ্রামে সে একবার মিছিল দেখেছে ভোটের সময়। মিছিলের সামনে ছিল এক ছোকরা। সারা শরীরে গাছের পাতা ঝুলিয়ে নানা ভঙ্গিমায় সে নেচে নেচে চলছিল। ভাঙা প্লেট বা পাতিল, যে যাই পেয়েছে তাতে গাছের ডাল কিংবা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঝনাৎ-ঝন্ শব্দ তুলে গ্রামবাসীরা ছোকরার পিছে পিছে সারা গ্রাম ঘুরেছে। দু’জন লোকের হাতে ছিল বাঁশের লাঠি। লাঠির মাথা ঝাজরা করে মাটির ‘সারোয়া’ শক্ত করে বাঁধা হয়েছিল। সারোয়া তে ছিল কিরোসিনে ডোবানো পাটের ‘হাপাল’। দাউদাউ করে আগুন জ¦লছিল হাপালে। ভাঙা প্লেটে একই তালে ঝনাৎ-ঝন্ শব্দের সাথে সবাই চিৎকার করে বলছিল- ‘মশাল’, ‘মশাল’, ‘মশাল’.....। সে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই ছিল খালি গা। মিছিল যেদিকে যাচ্ছিল, সেদিকের বাড়ি থেকে, মাঠের কাজ ফেলে রেখে লোকজন সামিল হচ্ছিল মিছিলে।

আর ‘আলোচনা সভা’ কি, তা হামিদ জানে না। তবে একবার ওদের গ্রামের স্কুল-মাঠে রাতে বায়োস্কোপ দেখানো হয়েছিল। বায়োস্কোপে সে একজনকে কাঁদতে দেখেছে। লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল উঁচু জায়গায়। সামনে লাখ লাখ মানুষকে পিঁপড়ের মতো দেখা যাচ্ছিল বায়োস্কোপে। সবার হাতে ছিল লাঠি। কয়েকজনের সাথে দাঁড়িয়ে লোকটি বলছিল- ‘‘ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি...’’। লোকটি কিছু কথা বলে আর চশমা খুলে চোখের পানি মুছছিল। হামিদ তার কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারেনি। কিন্তু হামিদেরও গলার ভেতর কু-লি পাকিয়ে কান্নার উপক্রম হয়েছিল।

তাহলে কালকে হামিদকে কি সেখানেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কিন্তু তাদের গ্রামের ভোটের মিছিলে কিংবা বায়োস্কোপের জনসভায় অংশীজনদের সবাইকে সাদা-গেঞ্জি, লাল-নিশান তো পরতে দেখেনি হামিদ। আবার দুপুরে খিঁচুরি খাওয়ানো, রাতে গান, এসবের কোনো কল্পচিত্র আঁকতে পারল না হামিদ। তবে সে খুবই উৎসুক। ভোর হয়েছে ভেবে রাতে দুই-তিনবার ঘুম ভেঙে গেল। সকালের আগেই সবাই গোসল সারলো। নতুন গেঞ্জি পড়ল, মাথায় বাঁধলো লাল ফিতে। কিন্তু গেঞ্জিটি হামিদের হাঁটু পর্যন্ত নেমে আসলো। মনটা খনিক খারাপ হলো তার। বোতাম ছেঁড়া ময়লা জামাটি গায়ে দিল হামিদ, মাথায় শক্ত করে বাঁধলো লাল নিশান। সবার সাথে সেও ট্রাকে উঠল। ট্রাক গিয়ে থামলো একটা চৌরাস্তা মোড়ে। সেখানে সে একজনের বিরাট আকারের ছবির দেয়াল দেখতে পেল। লোকটাকে তার চেনা মনে হলো খুব। এই শহরে আসার পর এই প্রথম একজন চেনা মানুষের নাগাল পেল সে। তবে ইনি কে তা মনে করতে পারছে না হামিদ। অনেক চেষ্টা করে হামিদের মনে পড়ল- হ্যাঁ ইনিই সেই লোক, যাকে সে বায়োস্কোপে দেখেছিল।

কালু’র কাছে জানতে পারল এনার নাম ‘বঙ্গবন্ধু’। সেদিন থেকে কারো মুখে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটি শুনলে হামিদের মনে হয়- এই শহরে অন্তত একজন ব্যক্তি আছেন, যাকে সে চেনে। হামিদ প্রায়ই মনে মনে ভাবে শহরে নিশ্চয়ই সে কোনোদিন ‘বঙ্গবন্ধু’র সাথে দেখা পাবে....। হঠাৎ ট্রাক স্ট্রাট করলে কে যেন একজন চিৎকার করে বলে- ‘দুনিয়ার মজদুর’......। সবাই তার জবাবে কী যেন বলল। হামিদকে চুপচাপ থাকতে দেখে  কালু তাকে কিছু স্লোগান শিখিয়ে দিল। যখন নেতা বলবে- ‘দুনিয়ার মজদুর’, তখন তাকে বলতে হবে- ‘এক হও, লড়াই করো’। নেতা যখন বলবে- ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’, তখন বলতে হবে- ‘লড়াই করে জিততে চাই’। নেতা বলবে- ‘এই লড়াইয়ে জিতবে কারা’, বলতে হবে ‘কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা’। কয়েকবার বলতে বলতে স্লোগান রপ্ত হয়ে গেল হামিদের। গলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে স্লোগান দিচ্ছে। অনেক কথার অর্থ সে বোঝে না ঠিকই কিন্তু রক্ত যেনো তার টগবগ করে উঠছে!

দুপুরে ট্রাক পৌঁছালো বিশাল এক জনসমুদ্রে। সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না হামিদ। চতুর্দিকে মাইক বাজছে। যিনি কথা বলছেন তার কণ্ঠস্বর এমন, যেন মাইক না-থাকলেও কথা শোনা যেত। মাইকের শব্দে বিরক্ত হলো হামিদ। তাছাড়া এত লোক বক্তার মুখই দেখা যাচ্ছে না। মাঠের শেষদিকটায় তারা দাঁড়িয়ে ছিল। পাশে একটা বট গাছ। অনেকে গাছে উঠে মঞ্চের লোকজনকে দেখছে। হামিদও তরতর করে উঠে একটা মোটা ডালে বসল। বড় একটা লাল ‘চকি’র মধ্যে বসে আছে জনা কুড়ি লোক।  চকির পেছনে লাল কাপড়ে কাস্তে, হাতুরি আর মুষ্টিবদ্ধ হাতের ছবি আঁকা। সবার গায়ে সাদা-গেঞ্জি আর মাথায় ও হাতে লাল-নিশান বাধা। একজনের পর আরেকজন উঠে উঠে কথা বলে আবার চকি’র উপর বসছে। হামিদ তাদের কথার মাথা-আগা কিছু বুঝছে না। উপরন্তু মাইকের বিকট শব্দে কানো ভো ভো ছাড়া কোনো অর্থবহ শব্দ পাচ্ছে না। তার চোখে ভাসছে তার নিজ গ্রাম ‘ঢিংটারী’র বিশাল কদম গাছটির কথা। বাদুর ঐ গাছের কদম যতটা খায়, তার দশগুন বেশি খায় গ্রামের ছেলেমেয়েরা। চোখ বন্ধ করে সেই কদমের স্বাদ আর গন্ধ পাচ্ছে হামিদ। দেখতে পাচ্ছে  ছোটো বোন ‘পারুল’সহ তোতা, দুলু, বিষ্ণু, ইলিয়াস, মানিক, শংকর, আমিন, মালতি, কাজলা ... সবাইকে।

একসময় লাল-চকি থেকে লোকজন নেমে গেল। চকিতে উঠেছে আরেক দল মানুষ। তাদের হাতে অনেক কিছু। হামিদ কেবল ঢোল আর হামমোনিয়ামটাই চিনলো। তবে এখানকার ঢোলগুলো কমন যেন ছোটো ছোটো। ঘাড়ে না ঝুলিয়ে টেবিলে বসিয়ে ঢোল বাজানো দেখে বেশ মজা পেল হামিদ। একজনের হাতে মাছ ধরা ‘ডারকি’র মতো একটা যন্ত্র। মহিষের শিংয়ের মতো লম্বা লম্বা তিনটা বাঁশি তিনজনের হাতে। ‘তুম্মা কদুর বস’ এর মতো তিনটা খোল নিয়ে একটা লোক যাদুকরে মতো পটাপট বাজাচ্ছে। এখন হামিদের কিছুটা ভালো ভাগছে। খাটো করে এক লোক লম্বা চুল দুলিয়ে গান ধরলো- ‘চম্পা ফুটিলো চামেলি ফুটিল, তার সুবাসে ব্যাকুল এমন নাচিলো রে...। হামিদ হঠাৎ খেয়াল করল অনেকেই মাঠ থেকে চলে যাচ্ছে। হামিদ নিচে তাকিয়ে ‘সেকেন্দার, রব্বানী, কালু, জাহাঙ্গীর, কেকারু’ ছাড়াও হোটেলের অন্য ছেলেদের কাউকে দেখতে পেল না। হামিদের গা শিউড়ে উঠল। সে এখন কার সাথে ফিরবে?

একবার সে বেতগাড়ি হাটে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। পরে বুদ্ধি খাটিয়ে ‘ঢিংটারি’ যাওয়ার রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রামের অনেক লোকের দেখা পেয়েছিল। কিন্তু এখানে যেসব রাস্তা এই বিশাল মাঠে মিলে গেছে, সেগুলোর সবগুলোকে একইরকম মনে হলো হামিদের। মাঠ থেকে বেড়ানোর আটটি রাস্তা খুঁজে হামিদ আরো দিকভ্রান্ত হয়ে গেল। কোনপথে পা বাড়াবে সে? এবার সে অন্য আরেকটা বুদ্ধি খাটানোর চেষ্টা করলো। যে ট্রাকে এসেছে সেই ট্রাকটিকে খুঁজলো। কিন্তু ট্রাকগুলোও তো দেখতে একইরকম! আন্দাজ করে একটি ট্রাকে উঠে পড়ল সে।

রাত এগারোটায় ট্রাক শহরে এসে বিভিন্ন মোড়ে দাঁড়িয়ে লোকজনকে নামিয়ে দিল। কিন্তু কোনো মোড়ই হামিদের পরিচিত নয়। বঙ্গবন্ধু’র প্রতিকৃতি ছিল যে মোড়ে সেটিও চোখে পড়ল না। কাঁদতে শুরু করলো হামিদ। ট্রাকের হেলপার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে নিজের নাম ‘হামিদ’ আর গ্রামের নাম ‘ঢিংটারী’ ছাড়া কোনো উত্তরই দিতে পারলো না। তবে সে সব খুলে বলল- চার দিন আগে সে গ্রাম থেকে শহরে এসেছে, হোটেলে টেবিল মোছার কাজ পেয়েছে, হোটেলেই রাতে থাকে, মাসিক বেতন সাতশ’ টাকা ইত্যাদি। সবশুনে হেলপার শহরটির নাম জিজ্ঞেস করলে হামিদ তালগোল পাকিয়ে ফেলল। একবার মনে হলো রংপুর শহর, পরক্ষণে ভাবল বগুড়া হতে পারে, আবার মনে পড়ল ঢাকা শহরের নাম। তাই সে শহরের নাম না বলে বলল- ‘যে শহরের চৌরাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধু’র বড় একটা ছবি বানাইছে, সেই শহর।’ হেলপার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে ড্রাইভারের শরনাপন্ন হলো।

সব শুনে ড্রাইভার রাতে গ্যারেজেই থাকার ব্যবস্থা করলো হামিদের। পরদিন থেকে গ্যারেজের পাশে ‘পাভেল ব্যাটারি সার্ভিসিং’-এ শুরু হলো হামিদের ভিন্ন কর্মজীবন। গাড়ি থেকে ব্যাটারি ডাউন করা, এসিড পাল্টানো, পানি ভরানো, ব্যাটারি চার্জ করা, ব্যাটারি আপলোড করার কাজ হয় এখানে। তবে হোটেলের চাইতে তার ভালোই লাগলো। হোটেলে এঁটো টেবিল মুছতে মুছতে হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে সাদা ঘা হয়েছিল। টেবিল মোছার পর খাবারের আঁশটে গন্ধে ঘিনঘিন লাগতো। এখানে  তার কাজ নির্ধারিত হলো- দোকানঘরের মেঝে ঝাড়– দেওয়া, ওস্তাদের পানের খিলি কিনে আনা, এটা-ওটা এগিয়ে দেওয়া আর ওস্তাদের কাজ দেখে দেখে কাজ শেখা। বিনিময়ে কোনো বেতন-ভাতা পাবে না, পাবে তিন বেলা খাবার আর দোকানঘরে ঘুমানোর সুযোগ।

এটাকেই ভক্তি ভরে মেনে নিল হামিদ। মনে মনে স্থির করলো, এখানে তো আর বেশি দিন থাকছে না সে। পরিচিত কারো দেখা পেলেই গ্রামে ফিরে যাবে। মা ও আর ছোটো বোন পারুলকে এখন মিস করছে খুব। মা কাজে বের হয়ে গেলে পারুল কার সাথে খেলে। হামিদ না থাকায় খেলার সময় সবাই ‘পারুল’কে মারে না তো? অথবা বেঈমানী করে পারুলকে হারিয়ে দেয় নাতো? না, সে এখানে থাকবেই না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে গ্রামে ফিরবেই। গ্রামের পরিচিত কারো দেখা না পেলে অন্তত আবার যেদিন ‘সাদা-গেঞ্জি’ পরে আর লাল-নিশান মাথায় বেঁধে জনসভায় যাবে, সেদিন সে হোটেলের সেকেন্দার, রব্বানী, কালু, জাহাঙ্গীর, কেকারুদের খুজে বের করবেই। তারপর হোটেলে ফিরে গিয়ে হোটেল মালিককে বলবে তাকে গ্রামে ফিরিয়ে দিতে আসতে।

মাস তিনেকের মধ্যে হামিদের ভেসে ওঠা বুকের পাজরের হাড্ডির ওপর চর্বি জগাতে শুরু করছে। এখনো হাড্ডিগুলো দেখা যায় কিন্তু গণনা করার মতো আর স্পষ্ট নয়। গায়ের রঙটাও আরো কালো হয়েছে কিন্তু ত্বকে তৈলাক্ত ভাব চকচক করছে। একরকম কেটেই যাচ্ছিল হামিদের। অল্পদিন পরে আবার বিধি বাম হলো। একটা ব্যাটারি তুলে এনে রাখতে গিয়ে হাত থেকে ছিটকে পড়ল। ব্যাটারি ফেটে এসিডে ভিজে গেল হামিদের মুখ, গলা, বুক আর পেট। দোকান মালিক তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে কোনমতো বারান্দায় ফেলে রেখে কেটে পড়ল।
তখন হামিদ অজ্ঞান। ঘণ্টা দুয়েক পড়ে থাকলো জরুরি বিভাগের বারান্দায়। কে তাকে ভর্তি করাবে? কিভাবে? গোলাপী বাসফোর ঝাড়– দিতে এসে বেওয়ারিশ লাশ ভেবে দূর থেকে মেঝে ঝাড় দিল। তারপর বারান্দার বসে পান চিবাচ্ছে। হঠাৎ দেখল লাশটি নড়াচড়া করছে। ছুটে গেল কাছে। নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখল নিঃশ্বাস চলছে। ছুটে গেল ভর্তি কাউন্টারে। বলল- ‘রে বাবু, মাটিতে লাশ লয়, বাচ্চাটি তো বাঁচিয়া আছে। হা, বাঁচিয়া আছে। বেবস্তা করো। ভরতি করিয়া লও’।

গোলাপী বাসফোর ছুটো ছুটি করে হাসপাতালে ভর্তি নিশ্চিত করলো। চিকিৎসা শুরু হলে ঔষধ-পথ্যের দরকার হলো। গোলাপী সাধ্যমতো চেষ্টা করলো কিন্তু কুলাতে পারলো না। গোলাপী’র পীড়াপীড়িতে হাসপাতাল সমাজসেবা এগিয়ে এলো। তিনমাস পর হাসপাতাল থেকে নাম কাটা হলো হামিদের। দু’চোখের পাতা ছাড়া সারা মুখের চামড়া ঝলশে বিকৃত হয়েছে। শ্বাসনালী পুড়ে কী সমস্যার কারণে হামিদ আর কথাও বলতে পারে না। পেটের চামড়ায় টান পড়ায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। এখন হামিদ যাবে কোথায়? গোলাপী জলকর সুইপার কলোনীতেই নিয়ে এলো হামিদকে। গোলাপীর স্বামী ‘রংলাল’ স্পিরিট খেয়ে কেবল ফিরেছে। গোলাপীর সাথে বিকৃত হামিদকে দেখে রেগে বলল- ‘মাগী হামি তুমার স্বামী আছে। তুমহার নাঙ কেনে লাগিবে, হা?’

রংলালের নেশা কেটে গেলে গোলাপী সব খুলে বলল। রংলালের মায়া হলো। হামিদের কাছে গিলে বলল- ‘বাবু, হামারা মেথর আছি। তুমহার সাকিন কাহা?’

হামিদ কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু গো গো শব্দ ছাড়া কিছুই বের হলো না। রংলাল বলল- ‘‘মেথর পট্টীতেই তোমার সাকিন হবে বাবু। হা। কোনো ছমোৎসা হবেক লয়। হা হবেক লয়।’’ হামিদ কিছু বলতে পারল না। হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকলো। দু’গাল বেয়ে মাটিতে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ল চোখের পানি। রংলালও কান্না সংবরণ করতে পারল না দু হাতে মুছে নিল নিজের চোখ।

অনেক দিন পর একদিন হামিদ দেখলো সুইপার কলোনীতেও সবার জন্য সাদা-গেঞ্জি আর লাল-নিশান এসেছে। পরদিন কেউ কাজে যাবে না। সাদা-গেঞ্জি আর লাল-নিশান পরে অনেকে যাবে মিছিল ও জনসভায়। গোলাপী হামিদকেও পড়িয়েছে সাদা-গেঞ্জি। দুই হাতে আর মাথায় বেধে দিয়েছে লাল-নিশান। রাস্তার পাশে হামিদকে চটের উপর বসিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে গোলাপী ও রংলাল দুজনেই। যারা মিছিল ও  জনসভায় যাবে তারা একে একে জড়ো হচ্ছে। মিস্ত্রিপাড়া থেকে একটা মিছিল আসছে। সুইপার কলোনীর বাসিন্দারা এই মিছিলের সাথে যুক্ত হয়ে জনসভায় যাবে।

মিছিল যতই কাছে আসছে ততই কাঁদছে হামিদ। আজ তার মিছিলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। ইচ্ছে ছিল জনসভা থেকে খুঁজে বের করবে হোটেলের ছেলেদের। তারপর ফিরে যাবে মায়ের কাছে। ছোট বোন পারুলের কাছে। মিছিলে যখন স্লোগান উঠছে ‘দুনিয়ার মজদুর’ কিংবা ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’ কিংবা ‘এই লড়াইয়ে জিতবে কারা’- সব স্লোগানের প্রতিস্লোগান দিচ্ছে হামিদ, যথাসাধ্য জোরে। কিন্তু গো গো শব্দ ছাড়া কিছুই বের হচ্ছে না। হামিদ চিৎকার করে গো গো করছে আর দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি।

চটে বসে কাঁদতে দেখে মিস্ত্রিপাড়া থেকে আসা মিছিলের কে যেন একটা পাঁচ টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়েছে হামিদের দিকে। তখনই ক্ষেপে উঠেছে রংলাল বাসফার- ‘রাম রাম রাম, হামারা ফকির লয় রে বাবু। হামারা কাজ করিয়া খাই। হামারা সুইপার আছি হা। তু লিয়ে যা গা টাকা’। রাগে রক্তবর্ণ চোখ কোঠর থেকে যেনো বেড়িয়ে আসছে রংলালের। হাতে ও মাথায় বাঁধানো কাস্তে-হাতুরি ও মুষ্টিবদ্ধ হাত খচিত লাল নিশান ঝাঁকিয়ে রংলাল আবারো বলল ‘হামারা ফকির লয় গা হা...’।

0 comments: