হাইটালি | জুলকারনাইন স্বপন

হাইটালি | জুলকারনাইন স্বপন

কিছু কিছু স্মৃতি মানুষ অনেক দিন মনে রাখে বা সযত্নে লুকিয়ে রাখে মনের গভীরে। এমনকী সারাজীবন ধরেই বয়ে বেড়ায়। বিশেষ করে শৈশব, কৈশোরের স্মৃতিগুলো মানুষের মনে দাগ কাটে বেশি। আর শৈশব, কৈশোরের স্মৃতিগুলো হয় মূলত খেলার সাথি, নিজ গ্রাম বা তার আশপাশের মানুষগুলোকে ঘিরে। স্মৃতিগুলো মনে হলে এক অনাবিল শান্তিতে ভরে যায় মন। এক অপার্থিব ভালোলাগায় ভরে ওঠে হৃদয়। স্মৃতিগুলোকে মানুষ নিজের মতো করে ভালোবাসে। ভাবে, এটা শুধুই আমার।

এমন অনেক স্মৃতি আজও মনে পড়লে কাজলের মনটা চলে যায় অনেক দূরে। সেই শৈশব, কৈশোর এসে ভেসে ওঠে তার চোখের তারায়... সেই গ্রাম, যে গ্রামের ধুলোমাটিতে একসময় মাখামাখি হত তার সারা শরীর... সেই মেঠোপথ, যে পথের ঘাসের ওপর শিশিরবিন্দুগুলো টলমল করত... সেই গাছগাছালি, সেই পাখিরা, সেই নদী মনে হয় আজও তাকে কাছে ডাকছে।

হুতোমপ্যাঁচাগুলো কি এখনও গভীর রাতে ডেকে ডেকে বুকে ভয় ধরিয়ে দেয়? হাঁসগুলো কি এখনও খেলা করে নদীর জলে? গায়েন কাকা কি এখনও দোতারা হাতে আসর জমায়? নাকি তিনি আদৌ বেঁচেই নেই! করুণা মাসী কি এখনও মাছ ফেরি করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে? জয়নাল নানা কি ফোকলা দাঁত নিয়ে রসের গল্প বলেই চলছে?

 জেলেপাড়ার মানুষগুলো কেমন আছে এখন? এখনও কি বেলবাজারের মেলা বসে... রঙিন মার্বেল...?

কাজলের শৈশবের বেশি অংশটাই কেটেছে গ্রামে। কিন্তু কৈশোর পর্যন্ত তার সাথে গ্রামের সম্পর্ক ছিল নিয়মিত এবং নিবিড়। সে তার গ্রামকে খুব ভালোবাসত যেমন সন্তান ভালোবাসে তার মাকে। আর ভালোবাসবে না-ই বা কেন! এই গ্রামেই যে তার জন্ম। এই গ্রামের আলো-বাতাসের সাথে তার শৈশব কেটেছে। আর যে নদীতে সারাদিন লাফালাফি করে তার চোখ লালবর্ণ ধারণ করত, শেষে মায়ের হাতের পিটুনি জুটত, সেই নদীকে ঘিরেই কাজলের গ্রামের অবস্থান। সেই নদীর ওপর অনেকাংশে নির্ভর করত এই গ্রামের মানুষগুলো।

গ্রামের নাম সুবর্ণপুর। যেমন নাম তেমনই সুন্দর গ্রামটি। ঝকঝকে তকতকে ছিল প্রতিটি উঠোন, কিন্তু অন্য দৃশ্যও ছিল; সেটা অবশ্য জেলেপাড়ার। শহর থেকে অনেক দূরে সুবর্ণপুর। একটি বড়ো রাস্তা এসে সুবর্ণপুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে অন্য একটি হাটে। এই রাস্তা দিয়ে এক হাঁটু ধুলা মাড়িয়ে গাড়োয়ানরা মালবোঝাই গরুর গাড়ি হাঁকিয়ে হাটে যেত। তাদের কণ্ঠে থাকত ভাওয়াইয়া গান... ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত চলিম মুই পন্থে পন্থে রে... কিংবা ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে, কোনদিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও, কয়া যাও রে...। আশপাশের বাড়ির বউ-ঝিরা গান শুনে ঘোমটার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখত। গাড়োয়ানদের উদাস কণ্ঠের সেই গান যুবতীদের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলত। সেই অজানা, অচেনা গাড়িয়ালের ব্যথাতুর কণ্ঠের সুর তাদেরকেও ব্যথিত করে তুলত। তাদের ভাবনার জগতে গাড়িয়াল এক গভীর ছাপ ফেলত। ফলে তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত অজানা গন্তব্যের দিকে।

বড়ো রাস্তার পাশ ঘেঁষে সুবর্ণপুর গ্রাম। চওড়ার চেয়ে লম্বার দিকেই বেশি বিস্তৃত। সুবর্ণপুর গ্রামের পর কিছুদূর আবাদি জমি। কোনো বাড়িঘর নেই। তারপর জেলেপাড়া। যদিও জেলেপাড়াকে সুবর্ণপুর গ্রামেরই অংশ ধরা হয় তথাপি কেমন করে যেন জেলেপাড়া নিজেকে আলাদা করে ফেলেছে। জেলেপাড়ার কিছু বৈশিষ্ট্যই হয়তো বা জেলেপাড়াকে স্বতন্ত্র একটি রূপ দিয়েছে।

জেলেপাড়ার প্রতিটি বাড়ি ঝুপড়ির মতো নিচু, কোনোরকমে মাথা হেঁট করে ঘরে ঢুকতে হয়। আর ঘরের ভেতরে ঢুকলেই মনে হবে আলো-বাতাসহীন এক বিভীষিকাময় অন্ধকার কূপে যেন ফেলে দেয়া হয়েছে। দম বন্ধ হয়ে আসে স্বল্প পরিসরের সেই ঘরে। এই ঘরেই অনেকগুলো মানুষ একত্রে ঠাসাঠাসি করে বাস করে বছরের পর বছর, জীবনভর। একটি বাড়ি ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে আরেকটি বাড়ি দাঁড়ানো। অবশ্য বাড়ি বললে ভুল হবে, কোনোরকমে একটি চালাঘর। রান্নাবান্না হয় বাইরে, খোলা আকাশের নীচে। সকাল-সন্ধ্যায় প্রতিটি বাড়ির সামনে বাঁশ গেড়ে জাল শুকোতে দেয় তারা। ফলে জেলেপাড়াটি জালের বেড়া দ্বারা ঢেকে যায়। বাড়ির পেছনটা তারা কলাপাতা দিয়ে আড়াল করার বৃথাচেষ্টা করে। ফলে ঐ কলাপাতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে দিনে রাতে কুকুর-শেয়াল অনায়াসেই যাতায়াত করে। জেলেপাড়ার বাড়িগুলো পাশাপাশি থাকলেও একটি ঘর জেলেপাড়া থেকে দূরে যেন শূন্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের বাইরে যতটা না শূন্যতা তার চেয়ে বেশি শূন্যতা ঘরের ভেতরে। ঐ ঘর বা বাড়ির চারপাশে কোনো আড়াল নেই। চারদিকই খোলা। সুনসান। এই শূন্যতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ঐ বাড়ির পরের ধু ধু বালুচর। আর কোনো গ্রাম নেই, নেই কোনো প্রাণের স্পন্দন। করুণা মাসী এক অসীম শূন্যতা নিয়ে এই ঘরেই বাস করে। একলা। বিধবা। স্বামী মারা গেছে সাপে কেটে। জেলেরা যে মাছ ধরে, সেই মাছ নিয়ে করুণা মাসী বাড়ি বাড়ি ফেরি করে। কখনো নগদ পায়, আর বেশিভাগই ধানচালের বিনিময়ে। সেই ধানচালগুলো সে বিক্রি করে সুবর্ণপুর হাটে। করুণা মাসী জেলেপাড়ার যে প্রান্তে থাকে, তার অপর প্রান্তে কিছুদূর এগোলেই নদীটা যেখানে সোজা পুবদিকে বাঁক নিয়েছে, সেখানেই সুবর্ণপুর হাট।

সুবর্ণপুর হাট বসে শনিবার আর মঙ্গলবার। এই গ্রাম ছাড়াও আরও দু-এক গ্রামের লোকজন তাদের প্রয়োজনীয় খরচাপাতি করে এই হাট থেকেই। সুবর্ণপুর হাট খুব একটা বড়ো নয়। স্থায়ী দোকানপাট নেই বললেই চলে। একটি মাত্র দোচালা দোকান আছে, যার মালিক বয়তুল্লা। হাটবার ছাড়া দিনে দোকান খোলা থাকে না। সন্ধ্যার পরে কুপি জ্বালিয়ে দু-এক ঘণ্টার জন্য খোলা হয়। দোকানের সামনে বাঁশের ফালি দিয়ে একটি টং পাতা হয়েছে। সন্ধ্যায় যারা পান খেতে বা বিড়ি ফুঁকতে আসে, তারা এই টঙে বসে আড্ডা মারে, গল্প-গুজব করে। মাঝে মাঝে গায়েন কাকা এসে দোতারা হাতে গানের আসর জমায়। হাটের দিন অবশ্য সারা এলাকা জুড়ে দোকান বসে। কেউ বা মাদুর পেতে, কেউ বা খড় বিছিয়ে কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে হরেক রকম জিনিসের পসরা নিয়ে বসে। কেউ খেতের সবজি, ধান, চাল-ডাল, কেউ হয়তো তামাকপাতা, পানপাতা দিয়ে পসরা সাজায়। লবণ থেকে শুরু করে মাছ পর্যন্ত এই হাটে পাওয়া যায়, শুধু মাংস ছাড়া। গামছা, লুঙ্গিও বিক্রি হয় এই হাটে। বাপের হাত ধরে যে ছেলেটি হাটে আসে, তার চানাচুর, মোয়ামুড়ি বা গুড়ের জিলাপির আবদারও রক্ষা হয় এই হাটে। কেউ বা ভাঁড় সাজিয়ে, কেউ নৌকা করে মালামাল নিয়ে আসে। হাটের দিন, বিশেষ করে মঙ্গলবারের হাটের দিনে গ্রামে একটা সাজ সাজ রব তৈরি হয়। কামার, কুমার, জেলে, কৃষক সবাই দুপুর হতেই কাজ ছাড়ে। প্রস্তুতি নিতে থাকে হাটে যাবার।

সুবর্ণপুর হাটের এক পাশে বিরাট এক বটগাছ। বটগাছটি তার শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত করে ছাতার মতো দাঁড়িয়ে আছে। বটগাছ থেকে কিছু লতা এসে মাটিতে গেঁথে বসেছে। সেগুলোই এক-একটি পিলারের মতো। হাটের অপর পাশে জেলেপাড়া লাগোয়া বিরাট এক কালীমন্দির। তেরো হাত লম্বা এক কালীমূর্তি স্বমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। কালীমন্দিরের পাশেই বিরাট লম্বা এক শিমুল গাছ তার দম্ভ নিয়ে আকাশ ছোঁয়ার অপেক্ষায়। তার দম্ভকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক জোড়া টিয়েপাখি। গাছের কোটরে বাসা বেঁধেছে তারা। সকাল-সন্ধ্যা হইচই, ঝগড়াবিবাদ করে এলাকাটা সরগরম করে রাখে। কালীপুজোর সময় সুবর্ণপুর হাটসহ মন্দির চত্বর এলাকায় মেলা বসে, যার নাম বেলবাজার। পুজোর সময় হিন্দুরা এখানে মানত করে কবুতর, পাঁঠা বলি দেয়। তখন দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসে।
এই মেলার জন্য গ্রামের মানুষ সারাবছর তাকিয়ে থাকে। যার যা প্রয়োজন তার সবকিছুই এই মেলায় পাওয়া যায়... আটা-চালা চালুনি থেকে দাদিমার সুপারি পেষার উড়–ন, ডালি, কুলা, হাঁড়িপাতিল, রসুন, মসলা... পরানবাবু বছরে একবার ধুতি কেনেন, তাও এই মেলায়... নাকের নথ, মাথার টিকলি, লালফিতা, নীলফিতা, লাঙলের ফলা, দা, কুড়াল, পাটের ছিকাই- স-ব। লাল-নীল রঙের মার্বেলের আকর্ষণে ঘুম ধরে না যে ছেলেটির, তার মুখে হাসি ফোটে মেলায় এলে। আর কত রকমের খাবারদাবার। মিষ্টি, গজা, তালমিছরি, বাতাসা, তিলের খাজা, খোরমা ইত্যাদি। গ্রামের কিশোরী মেয়েরা মেলায় আসে দল বেঁধে। আনাড়ি হাতে মা-বোনের রঙিন শাড়ি পরে কোনো কারণ ছাড়াই খিলখিল করে হাসতে হাসতে তারা মেলায় আসে। রঙিন চুড়ি, কোমরের বিছা, আয়না, তিব্বত স্নো তারা কিনবেই। এই মেলার সময় সুবর্ণপুরসহ আশপাশের গ্রাম সরব হয়ে ওঠে। জেলে তার জাল ছাড়ে, হালুয়া তার হাল ছাড়ে। সবাই এক উৎসবে মেতে ওঠে।

সুবর্ণপুর গ্রামসহ চারপাশের গ্রামের মানুষজনের জীবনযাপন, জেলেদের জীবিকানির্বাহ, উৎসব সবকিছু যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় সে আর কেউ নয়- হাইটালি। একটি নদী। শাখানদী। একসময় যৌবনকালে দু-কূল ছাপিয়ে জল উছলিয়ে পড়ত। শুকনো মৌসুমে পানির স্তর নেমে যখন প্রায় হাঁটু-সমান হত, তখন মানুষ নৌকা ছাড়াই এপার-ওপার করত হেঁটে হেঁটে। কাপড় না ভিজিয়েই এই নদী তখন পার হওয়া যেত। সেই থেকেই এই নদীর নাম হয়ে যায় হাইটালি।

হাইটালির পানি দিয়েই এলাকার চাষাবাদসহ সকল কাজ হয়ে থাকে। জেলেরা ডিঙি ভাসিয়ে মাছ ধরে সকাল-বিকাল-রাতে। সেই মাছ বিক্রি হয় গ্রামে গ্রামে, হাটে হাটে। এই নদীতেই ডিঙি ভাসিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে যায় দূর থেকে বহুদূরে। কখনো দুই দিন, কখনো তিন দিন তারা ডিঙিতেই থাকে, খায় দায়। এই হাইটালি যোগান দেয় অনেকগুলো মানুষের জীবন বাঁচার রসদ। চাষিরা সকালবেলা এই নদী পার হয়ে ওপারে যায় ক্ষেতে কাজ করতে। আবার ফসল তুলে ডিঙি দিয়ে নিয়ে আসে এপারে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ডাঙায় গোল্লাছুট, ছি-বুড়ি খেলে যতটা না আনন্দিত হয়, তার চেয়ে বেশি মজা পায় হাইটালির পানিতে দাপাদাপি করে। তারা শাপলা-শালুক তোলে পরম আনন্দে, ছিপ দিয়ে মাছ ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গাঁয়ের বউ-ঝিরা কাপড় কাচতে এসে উদাস হয়ে বসে থাকে হাইটালির পাড়ে। শেষে অবেলায় গোসল সেরে ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফিরে শাশুড়ি অথবা মায়ের বকুনি। রাখালরা তাদের গরু-ছাগলকে পানি খাওয়ায় এই নদীতে। তারপর সেগুলোকে গোসল করিয়ে গাঁয়ের পথ ধরে। সকালবেলা থালাবাসন মেজে কলসিতে পানি ভরে ঘোমটার ফাঁকে এপাশ-ওপাশ দেখতে দেখতে চঞ্চলা হরিণীর মতো চলে যায় নতুন বউ। এই হাইটালিই পানির যোগান দেয় এই অঞ্চলের অধিকাংশ প্রাণীকুলের। নৌকায় পাট বোঝাই করে মাঝিরা গান গাইতে গাইতে চলে যায় কোনো এক হাটে বা বন্দরে।

কিন্তু সেই হাইটালি এখন যৌবন পেরিয়ে পড়তি বয়সে। বয়সের ভারে সে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণকায় হয়েছে। তার প্রাণ জল, সেই জল আর প্রবাহিত হয় না তার বুক চিরে। সে বুকে এখন জেগেছে চর। শুকনো বালুচর। সে বালুচরে না জন্মে ঘাস, না জন্মে ফসল। কাজল কি জানে হাইটালির এই করুণ পরিণতি? সে কি শুনতে পায় তার হৃদয়ের কান্না? হাইটালির তীব্র আর্তনাদের কথা কাজল কি জানে? সে কি অনুভব করতে পারে হাইটালির কষ্টের তীব্রতা? হাইটালির কান্না, আহাজারি ভেসে বেড়ায় এখন সুবর্ণপুর গ্রামের আকাশে-বাতাসে। হায় হাইটালি...!

0 comments: