- জানুয়ারী ২০১৯ সংখ্যার সম্পাদকীয়
- কবিতা
- গল্প
- গদ্যবিচিত্রা
- কুড়িগ্রামের সাহিত্য চর্চার খসড়া | শ্যামল ভৌমিক
- সমকালীন কবিতা ও বোধের কিছু দিগন্ত | গোলাম কিবরিয়া পিনু
- চিত্রশৈলী
- ভিডিও
সর্বশেষ
জানুয়ারী ২০১৯ সংখ্যার সম্পাদকীয়
প্রদীপের আলোর নিচেই অন্ধকার, চর দখলের ঢোল বাজছে, দখল হয়ে যাচ্ছে
সময়, মানুষ, শিল্প-সাহিত্যও।
বিজ্ঞাপন-ভিত্তিক মিথ্যাচার ;
এক নম্বর উৎকৃষ্ট পণ্য. পেটেন্ট বুদ্ধিজীবী ........
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ........
বিবেক-পচন ও অস্তিত্ব-সংকট প্রতিরোধে
বিজ্ঞাপন-প্রভাবিত পণ্য
পরিহার করাই শ্রেয়।
ভাববাদ না বস্তুবাদ ........... কনফিউসন........
কনফেশন করতেও ভয়।
বর্ণচোরগণ তাদের বিকৃত দ্বৈতরূপ
সযত্নে লুকিয়ে রাখে
তথাকথিত প্রগতিবাদী খর্বকায়
অস্তিত্বে। শিল্পের বনসাই সংস্করণ,
বিজ্ঞাপন-আধিক্য সাহিত্য
আমরা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করি।
শুদ্ধ শিল্পের অন্তর্গত সৌন্দর্য
আমাদের মুগ্ধ ও
সাহসী করে ; তাই সময়-আক্রান্ত
জীবনের খোঁজে
দূর্গম সময়ের বুক চিরে আমাদের তীর্থযাত্রা।
চলতি সংখ্যাটি কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার অধ্যাপক তপন কুমার রুদ্রের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করা হল।
পাঠক, আপনাকে ধন্যবাদ।
কুড়িগ্রামের সাহিত্য চর্চার খসড়া | শ্যামল ভৌমিক
সাহিত্য হচ্ছে সংস্কৃতি-কৃষ্টির ধারক বাহক। সেই অর্থে একটি দেশ জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি সাহিত্যের অবয়বে লালিত হয়, পরিষ্ফুটিত হয়, বিকশিত হয়। সাহিত্য ব্যতীত দেশ ও জাতির অস্তিত্ব শূন্য গর্ভের মতই।
তাই এর চর্চা ও লালনে সকলকেই এগিয়ে আসা উচিত। “সভ্যতা বিনির্মাণেও সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।”
সাহিত্যে যেমন আত্ম-উপলব্দির বিকাশ ঘটে, দেশ জাতির বাস্তব চিত্র ফুটে উঠে তেমনি তা নতুন প্রজন্মের নিকট এক অনুকরণীয় অধ্যায়রূপে বিবেচিত হয়।
সাহিত্য চর্চায় কুড়িগ্রাম জেলার বিশাল ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অনেক যুগান্তকারী লেখক কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক, নাট্যকার গোলাম সারোয়ার ও আব্দুল হাই সিকদার উচ্চ মর্যাদায় আসীন। তাঁরা তিন’জনেই তাঁদের জন্মস্থানের ঠিকানা কুড়িগ্রাম বলে গর্ববোধ করেন। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক সম্প্রতি ইহলোক ত্যাগ করেও কুড়িগ্রামকে করে গেছেন সমৃদ্ধ।
রংপুর সদর এলাকা ও কুড়িগ্রাম এলাকার লোকদের মুখের ভাষা ও কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে কোন তফাৎ নেই। চর্যাপদের ভাষা ও নাথ সাহিত্যের ভাষা থেকেও এসত্য ইতিমধ্যে পন্ডিতগণ প্রমাণ করেছেন। পন্ডিতগণ এও দাবী করেছেন যে চর্যাপদের ভাষা বহুলাংশে রংপুর-কুড়িগ্রামের ভাষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ভাওয়াইয়া পল্লীগীতি বাংলা সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। ভাওয়াইয়া পল্লীগীতির কিংবদন্তী শিল্পী আব্বাস উদ্দিন কুড়িগ্রামের উত্তর প্রান্তের থানা শহর ভূরুঙ্গামারীর সীমান্তবর্তী তোরশা নদীর পাড়ের মানুষ। এক সময় কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী সড়ক ছিল তার বিচরণ পথ। কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাই ছিল তার গানের ভাষা। আব্বাস উদ্দিন কুড়িগ্রামের গৌরব ছিলেন। বৃহত্তর রংপুরেরও গৌরব, বাংলাদেশের গৌরব, বাঙালী জাতির গৌরব। ‘কুড়িগ্রাম জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে বিষয়টি সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।
সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’ ও ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকদ্বয় বাংলাদেশের সব জেলা শহরে ও ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন জেলাসহ কলকাতাতেও সাড়া জাগিয়েছে। এই নাটক দুটি সমকালীন শ্রেষ্ঠ নাটকের স্বীকৃতিধন্য হয়েছে, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় বাঙালীর গৌরবকে আরো একবার সমুন্নত করেছে। এ দুটি নাটকের ইংরেজি সংস্করণ বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। সৈয়দ হকের অন্যান্য কবিতার ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর নাটক ও কবিতা বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে রয়েছে। দেশবরেণ্য এ লেখকের অনেক কাব্যগ্রন্থ, গল্প, নাটক, উপন্যাস জনপ্রিয় হয়েছে পাঠকদের কাছে। তার লেখা সংগীত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ গৌরব সবার, এ গৌরব কুড়িগ্রামের, রংপুরের, বাংলাদেশের। এ গৌরব সকল সাহিত্য গবেষকদের।
ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক প্রয়াত তপন কুমার রুদ্রের কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতায় শ্রেনীঘাত’ ও ‘মাকে বলা আমার কিছু মিথ্যে কথা’ প্রবন্ধ 'প্রাক-পরিচয়' এবং উপন্যাস ‘অংশী’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তার অনেক কবিতা-প্রবন্ধ জাতীয় ও স্থানীয় পত্রপত্রিকার পাশাপাশি বিভিন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে যা জাতীয় মানের। মোস্তফা তোফায়েল হোসেন এর ‘কুড়িগ্রাম ও রংপুর জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থ প্রকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বাংলা ও ইংরেজি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও তার ইংরেজি-বাংলা দ্বিভাষীক কাব্য ঢাকা বই মেলায় ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে। কুড়িগ্রামের সাহিত্যকদের মধ্যে যার নাম বার বার ফিরে আসে তিনি প্রয়াত শিক্ষক আব্দুল হামিদ। যার অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক স্থানীয় সাহিত্যপত্রিকা সহ জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। যার মাধ্যমে অনেক সাহিত্যকর্মীর সৃষ্টি হয়েছে এই কুড়িগ্রামে। কুড়িগ্রামের একজন প্রবীণ আইনজীবি সরকার আব্দুল করিম শৈশব থেকেই এখন পর্যন্ত নিরবেই নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করে যাচ্ছেন। তার কোন বই প্রকাশিত না হলেও তার অসংখ্য কবিতা গল্প সাহিত্যপত্রিকা সহ স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে।
সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক একাধারে নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও উপন্যাসিক। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে ‘প্রাণহীন প্রতিকৃতি’, নির্বাচিত গল্প ও প্রবন্ধের বই ‘আত্মদার্শনিক প্রেক্ষিতে কবিতার অবস্থান’।
সাংবাদিক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনের প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘বাসন্তী কথা’, প্রবন্ধ ‘অপরাজনীতি ও অন্যান্য’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ ও নিবন্ধ জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা ও সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ হয়।
নূর উন নবী বাবুর লেখা মাঝে মাঝেই বিভিন্ন দৈনিক ও ম্যাগাজিনে দেখা যায়, তার প্রবন্ধের বই ‘বঙ্গবন্ধুর কর্মযজ্ঞ ও দ্বিতীয় বিপ্লব’ প্রকাশিত হয়েছে।
সাংবাদিক মমিনুল ইসলাম মঞ্জু শক্তিমান সাহিত্যকর্মী, তাঁর বেশকিছু প্রবন্ধ বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য সাময়িকীসহ স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকার প্রকাশিত হয়েছে।
প্রতিভাবান লেখক, আলোচক, উপস্থাপক চঞ্চল বোসের প্রবন্ধ বিভিন্ন গবেষণা পত্রিকায় বেরিয়েছে। এছাড়াও তার কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে।
কবি মিজান খন্দকারের কাব্যগ্রন্থ ‘যথাকবি নিরঞ্জন’, ‘জন্মান্তরিত হবো কোন নব গৃহে’, গল্প ‘পুনশ্চ যুদ্ধার্থীগণ’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তার অসংখ্য কবিতা প্রথম আলো, ভোরের কাগজ, জনকণ্ঠ সহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রায়ই দেখা যায়।
হেলাল জাহাঙ্গীর নাটক রচনা করে ইতিমধ্যেই নাট্যকার হিসেবে বেশ খ্যাতি পেয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য নাটক গুলো হচ্ছে ‘মহানন্দা’, ‘উত্তরে অগ্নিকাল’, ‘বিপ্লব বক্ষে স্বদেশ’। এছাড়াও তার দুটি কবিতার বই ‘আলোর উপরে আলো’, ‘জ্বলে প্রেম! জ্বলে আজন্ম বিপ্লব!!’ প্রকাশিত হয়েছে।
আব্রাহাম লিংকন এর কবিতার বই ‘শেষ যুদ্ধের ডাক দিয়ে যাই’, ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস’, ‘মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস রংপুর’ সহ বাংলা একাডেমির ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’ চতুর্থ খন্ডে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তার লেখা নিয়মিত জাতীয় দৈনিকে দেখা যায়।
কবি জ্যোতি আহমদ, ইমতে আহসান শিলু, সোলায়মান বাবুল, জামাল অন্তর, জুলকারনাইন স্বপন, মাইকেল রবিন সরকার, আশিষ বকসী, আলমগীর কবির, লাইলি বেগম প্রমুখ এর কবিতা নিয়মিত বিভিন্ন সংকলন ও ছোট কাগজে প্রকাশিত হয়েছে, এঁদের কবিতা বই আকারে প্রকাশ করার যোগ্যতাসম্পন্ন। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে এঁরা ইতিমধ্যে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে।
প্রয়াত লেখক হোসনে আরা পারুলের বেশ কিছু কবিতা উপন্যাস ও গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে।
সাংবাদিক আব্দুল খালেক ফারুক’র গল্পগ্রন্থ ‘কাঁটাতারে ঝুলে আছে ফেলানী’, নাটক ‘গোলামের দরবার’ ও উপন্যাস ‘সন্দেহভাজন’ প্রকাশিত হয়েছে।
জুলকারনাইন স্বপন এর গল্পগ্রস্থ ‘অতলে জীবন’, ইউসুফ আলমগীরে’র কবিতার বই ‘চক্করে চক্করে ওড়ে বাউরি বাতাস’, মাইকেল রবিন সরকার সম্পাদিত কবিতার বই ‘কিছু মেঘ ছায়ার শরীর’, মাহফুজুর রহমান লিংকন’র কবিতার বই ‘অমীমাংসিত ফুলের দেবতা’, সজল সমুদ্রে’র কবিতার বই ‘পত্রে রচিত ভোর’ ও ‘ডালিম যেভাবে ফোঁটে’, মাহবুব অনিন্দ্য’র কবিতার বই ‘অপার কলিংবেল’, সাম্য রাইয়ান এর প্রবন্ধের বই ‘সুবিমল মিশ্র প্রসঙ্গে কতিপয় নোট', কবিতার বই ‘বিগত রাইফেলের প্রতি সমবেদনা’, ‘মার্কস যদি জানতেন’, রাশেদুন্নবী সবুজের কবিতার বই ‘অ্যা ড্যান্স নাইট জার্নাল’, উত্তম চৌধুরীর উপন্যাস ‘উমা অন্তর দহনে’, বাদশা সৈকত’র গল্পগ্রন্থ ‘জীবনের ছায়াপথ’, উপন্যাস ‘পলায়ন’, ‘তোমার জন্য লেখা’ কাব্য গ্রন্থ, ‘সর্ম্পকের দেয়াল’ সহ বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলার সহকারী অধ্যাপক সুশান্ত বর্মন প্রবন্ধ ও শিশুতোষ গল্প রচনায় যথেষ্ট পরিচিতি পেয়েছেন।
নবীনদের মধ্যে আতিকুর রহমান মিলু ‘শাব্দিক’ নামে একটি ছোট পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করছেন। এছাড়াও অাকরাম হোসেন, জাহানুর রহমান খোকন সহ বেশ কিছু নতুন ছেলে সাহিত্য চর্চায় অবদান রাখতে শুরু করেছে।
মনোরঞ্জন বর্মন উলিপুর থেকে একাধারে প্রাবন্ধিক, সমালোচক এবং ইতিহাস লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। কাফী বীর ও সাংবাদিক পরিমল মজুমদার শক্তিমান সাহিত্যকর্মী। ‘চিলমারীর ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক নাজমুল হুদা পারভেজ সম্ভাবনাময় লেখক। নাগেশ্বরীর কাদের, রেজাউল করিম রেজা, মেধাবী সাহিত্যের কর্মী। শ্বাশত ভট্টাচার্য গবেষক ও প্রাবন্ধিক। তিনি ‘রংপুর জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থে রংপুর জেলার ‘মেলা’ বিষয়ের প্রবন্ধকার, আলোচক। কুড়িগ্রামের সংস্কৃতি জগতের প্রায় অনুচ্চারিত দুটি নাম শামসুল ইসলাম মন্ডল ও দেবব্রত বকশী। প্রথমজন আলোচক, দ্বিতীয় জন বেতার ও মঞ্চ নাট্যকার, অভিনেতা ও গায়ক।
প্রিয় পাঠক এ লেখায় কুড়িগ্রামের সাহিত্যকর্মীদের সকল বিবরণ রয়েছে বলে আমি দাবী করি না। তবে আগামীতে কুড়িগ্রামের সাহিত্য চর্চার ইতিবৃত্ত রচনা করতে লেখাটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করতেই পারি।
* শ্যামল ভৌমিক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
অভিযোগহীন একজন | বাদশাহ্ সৈকত
নিজের এ পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে এখন সব সময় খুব কম কথা বলার চেষ্টা করে সেটা যে কারো সাথেই হোক না কেন। তাছাড়া বেশি কথা বলার মতো অহংকার বা গৌরবের কোন ঘটনাই যেন তার জীবনে একটিও ঘটেনি। তবে ইদানিং মানুষের বলা কথা গুলো শুনতেও ভালোলাগে না তার। সব যেন অন্তঃসারশূন্য। জ্ঞানহীন মানুষদের জড় পদার্থের মতো মনে হয়।
এজন্য পরিচিতজনদের সাথে মেলা-মেশাও কমিয়ে দিয়েছে। ধুঁকে ধুঁকে সরকারী চাকুরীতে বয়সের সীমা-রেখা পেরুনোর পর শহরেও যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। ভাললাগে না কোন কিছুই। প্রতিদিন একই রাস্তা, একই মানুষের মুখ, একই দোকানপাট, চায়ের দোকান, পান সিগারেটের দোকান।
পরিচিত দোকানের চা গুলোও কেমন জানি পানসে হয়ে গেছে। তার উপর চায়ের দোকান গুলোতে বেশি দিন বেঁচে থাকার আশায় ফ্যাশানের মতো চিনি ছাড়া চা খাওয়া লোকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নিজের ভবিষ্যৎ রোগ-ব্যাধি ও মরণের চিন্তাটাও মাঝে মধ্যে মনের ভিতর ঘুরপাক খেতে থাকে।
লাক্কু মিয়া তখন ভাবে, ধুর মরণে তার আবার ভয় আছে নাকি? সেতো কবেই মরে গেছে। এখন আর মরলেই বা কি, বাঁচলেই বা কি? তাছাড়া চায়ের দোকানে বসলে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের পেচাল গুলোও বিষাদিত লাগে তার কাছে। নিজের জীবনের চেয়েও দলকে, নেতা-নেত্রীকে বেশি ভালোবাসার গল্প শুনলে পাছায় স্ব-জোড়ে লাথ্যি মারতে ইচ্ছে করে। রাজনীতির সংজ্ঞা না জানা এসব লোকরাই দেশটার বারোটা বাজিয়েছে।
এসব কিছু ভেবেই শহরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে লাক্কু মিয়া। এখন বাসাতেই রুমের ভিতর দিন রাতের বেশির ভাগ সময় কাটে তার। সরকারী চাকুরীজীবি অহংকারী বউটাকে ভালো না লাগলেও তার মন মানষিকতার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছে এটাই আসল কথা।
বউটাকে ভালো লাগে না বললে ভুল হবে, বউয়ের আচরণ ভালো লাগে না। মেধাহীন মনে হয়। কিন্তু সে কথা বললে ঝামেলা বাড়তে পারে, এজন্য বলা হয় না। বিয়ের আগে রাতভর মোবাইলে সোনা-পাখি, ময়না-পাখি বলে ডাকা আদরের কথাগুলো এখন প্রতারনার মতো মনে হয়। বিয়ের আগে বউকে উদার আর মহতি মনে হলেও এখন ভুয়া মনে হয় সব কিছুই।
লাক্কু মিয়ার মনে হয় বিয়ের আগে যে মেয়েরা তার প্রেমিককে কথায় কথায় বাবা-মায়ের খোঁজ খবর নিতে বলতো সেই মেয়েরাই বিয়ের পর কালক্ষেপন না করে শশুর-শাশুরির মুখে লাথি মেরে আলাদা সংসার পাতে। ভালোবেসে বিয়ে করা বউ আকতারি পারভিনের এমন আচরণ সত্যিই অবাক করে দিয়েছে তাকে। প্রাইমারীতে চাকুরী করা সকল মেয়ে মানুষরাই মনে হয় তার বউয়ের মতো।
লাক্কু মিয়া ভাবে, কথায় কথায় ডিভোর্সের হুমকি দেয়া এসব মহিলারা নিশ্চিত একদিন জাহান্নামে যাবে। শুধু মাত্র তিন বছরের মেয়ে উর্মিতা না থাকলে কবেই কপালে গুড়ি মেরে চলে যেত এমন অশিক্ষায় শিক্ষিত বউয়ের সংসার থেকে।
একমাত্র মেয়েটার কারনেই, মেয়েটার বাবা ডাকের কারণেই সম্ভব হয় নাই। তবুও পুরুষ হয়ে ঘরের মেয়েলি কিছু কাজ করার সময় ভীষন রাগ হয় তার। মনে হয় সব ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে অথবা রেখে দুরে কোথাও চলে যায় সে।
লাক্কু মিয়ার মনে পড়ে তার এই দজ্জাল প্রকৃতির বউ আকতারি পারভিনের জন্য মায়ের কত গালি খেতে হয়েছে তাকে। হারামজাদা, বউয়ের গোলাম। বউকে কিছু বলার সাহস নাই তোর। রাত হলে বউ গায়ে হাত দিতে দিবে না এই ভয়ে কিছু বলিস না। বের হয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। কুলাংগার কোথাকার।
গর্ভধারিণী মায়ের মুখে এসব কথা শুনে মাঝে মধ্যে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সাধ মিটে গিয়েছিল তার। রাতে দিনে অহরহ চলতো এসব বাক্য বিনিময়। বউ কথার মাঝে কিছু একটা বলে চুপ করে থাকতো। তারপর চলতে থাকতো গালিসহ অভিশাপের পালা।
হাজার হোক মা জননী। দশ মাস দশ দিন গর্ভে রেখেছিল তাকে। চুপচাপ সহ্য করতে হতো সবকিছুই। তবুও মাঝে মধ্যে মুখ ফসকে মায়ের কথার উত্তরে যেই বেরিয়ে যেত’ মা আজকাল সরকারী চাকুরীজীবি বউকে ইচ্ছে হলেও কিছু বলা যায় না। আর কোথায় যায়।
মায়ের পায়ের রক্ত যেন মাথায় উঠে যায়। গলার জোড় দ্বিগুণ বাড়িয়ে বলতে থাকে বউয়ের পা চাটা গোলাম। এই মুহুর্তে তোর বউ ছোয়া নিয়া বাড়ি থেকে বের হয়া যা। তোর মতো বেহায়া বেটার দরকার নাই আমার। তুই রাস্তা-ঘাটে পড়ে মর। এমন বউ বেটার কপালোত গুড়ি মারং বলার সাথে সাথে মাটিতেও দুইটা গুড়ি মারে।
এসময় বাবা নিশ্চুপ শ্রোতার মতো শুনতে থাকে। লাক্কু মিয়া জানে তার বাবা নওয়াব আলী একজন মাটির মানুষ। বউ ছালেহা বেগমের কথায় উঠবস করেন তিনি। দেখে মনে হয় সংসারে নওয়াব আলীর কিছু নাই। সব তার মা বাপের বাড়ি থেকে এনে সংসার পেতেছে। তার দয়ায় এ সংসারে বেঁচে আছে সবাই।
বাবা কিছু বললেই দাবাড় মেরে বলে, ছেলে বউকে শিক্ষা করতে পারে না আর আমার উপর খবরদারী। বাবার ভাত পর্যন্ত বন্ধ করারও হুমকী দিত মা জননী।
কিন্তু ছেলে-বউয়ের প্রতি মায়ের এই রাগের রহস্যটা ঠিক মতো বুঝতে পারে না লাক্কু মিয়া। বউ তার সংসারের কোন কাজের ধার ধারে না এজন্য নাকি অন্য কোন কারন। নাকি বউ তার বাড়িতে থেকে বসে শুয়ে খেয়ে খেয়ে চাকুরী করে পুটলি গোছায় এজন্য।
এই সাধারণ ঘটনায় মায়ের এতো রাগের কারণ কি তা আজও অজানা তার কাছে। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই তো দেখে আসছে এতো বেশি রাগের মহিলা ছিল না তার মা।
বউটাকে আনার পর কিছুদিন ভালোই ছিল। তারপর কেন যে এতো রাগ সব সময় খিচির-মিচির করতে থাকলো তা কে জানে।
এক পর্যায়ে বাপ-দাদার ভিটে মাটি ছেড়ে শহরের নিকটবর্তী ভাড়া বাসায় বউয়ের সাথে থাকতে বাধ্য হল লাক্কু মিয়া। বউ-মেয়ের সাথে থাকতে থাকতে মাঝে মধ্যে নিরীহ বাবা ও গর্ভধারীণী মায়ের জন্য মনটা খারাপ হয় তার। কিন্তু মায়ের পক্ষ নেয়া ছোট ভাইদের ন্যায় অন্যায় বলা কথা গুলো মনে পড়লে দুঃখ কিছুটা নিবারন হয়।
যে ছোট ভাইদের কোলে পিঠে মানুষ করেছিল সেই ভাইয়েরা যখন তাকে বালকামা, বেয়াদব, বউয়ের ভাড়ুয়া বলে গালি দিত। মায়ের কথায় মারতে আসতো পর্যন্ত। সেসব কথা ভাবলে এখনও চোখে পানি আসে তার।
লাক্কু মিয়া ভাবে, এমন মা ভাইয়ের সংসারে মর্যাদা নিয়ে থাকার চেয়ে গোপনে রুমের ভিতর ভালোবেসে বিয়ে করা বউটার ন্যায় অন্যায় কিল ঘুষিই অনেক ভালো। ভাবে সেতো আর রক্তের কেউ না। এজন্য বউয়ের কথায় এখন আর কোন দুঃখ বোধও হয় না তেমন।
অভিযোগহীন মানুষের মতো সোনার ডিম পাড়া বউয়ের কথায় কাপড় কাচা, তরকারী কোটাসহ রান্না-বান্নার কাজটাও নীরবে করে দেয়। ভাবে শুধু ভাগ্যের দোষে তার আজ এ অবস্থা।
নতুন সংসারে প্রথম প্রথম এসব করতে ভীষণ রাগ হতো লাক্কু মিয়ার। ভালোবেসে পাওয়া সাত রাজার ধন আকতারি পারভিনের সাথে রাগ করে কথাই বলতো না তিন দিন, সাত দিন এমনকি পনের দিন পর্যন্ত। বউ রাগ করে বাপের বাড়িতে গেলে মনের দুঃখে, ক্ষোভে খেয়ে না খেয়ে বিছানায় শুয়ে সময় কাটাতো। এসময় গুলোতে খুব রাগ হতো সৃষ্টি কর্তার উপর। কি প্রয়োজন পড়েছিল সৃষ্টি কর্তার তাকে দুনিয়ার মুখ দেখানোর।
আলাদা সংসারে থাকতে দুইবার রাগ করে ঢাকাও গিয়েছিল সে। একবারতো এক মাস পার হওয়ার পরও ফিরে আসেনি। পরে আবার জানি কেমন করে বউয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল বুঝতেই পারেনি।
মেয়েটার প্রতিতো মন টানছিলই, পাশাপাশি দুই তিন দিন পার হতেই কেমনে জানি বউটার প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল, মনের ভিতর শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। পরে সরকারী চাকুরীজীবি বউয়ের সামান্য ভালোবাসাই তাকে সংসারে ফিরিয়ে এনেছে।
তবে লাক্কু মিয়া মাঝে মধ্যে ভাবে তার নিজেরই বুঝি লজ্জা শরম কিছু নাই। তাছাড়া কি এমনই বা আছে আকতারি পারভিনের মাঝে শুধু সংসার চালানোর জন্য প্রতিমাসে বেতনের টাকা কয়টি ছাড়া। আর বেতনের টাকা কয়টা ব্যাংক থেকে তোলার পর নিজের বাবা-মা, ভাই-বোনের প্রতি দরদ যেন উছলে পড়ে। যেন তারা মেয়ের সরকারী চাকুরীর বেতনের দিকে চেয়ে আছে।
আগে প্রায় সময় এমন একটি সরকারী চাকুরী জোটাতে না পাড়ার ব্যর্থতায় নিজের উপর ধিক্কার দিত লাক্কু মিয়া। তার সকল যোগ্যতা থাকার পরও কেন সরকারী চাকুরী জোটাতে পারেনি সেটাও ভালো করে জানা আছে তার।
সে জানে চাকুরী নেয়ার জন্য অন্য দশজনের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্যতা আছে তার। সেকথা আকতারি পারভিনও জানে। শুধুই বালের রাজনীতি। এই রাজনীতিই জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে। রাজনৈতিক নেতা আর আমলারাই তাকে ভালোভাবে বাঁচতে দিল না। বাবা-মা, ভাই-বোনের সংসার থেকে তাকে আলাদা করে দিয়েছে। এজন্য আজ অবধি রাজনীতির প্যাচাল সহ্যই করতে পারে না সে।
লাক্কু মিয়া ভাবে একজন ভালো ছাত্রের গৌরব নিয়ে বেড়ে ওঠা যৌবনে রাজনীতি সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে পারে তা সে সময় বুঝতেই পারে নাই সে। যে গৌরবেই আকতারি পারভিনের মতো একজনকে বউ হিসেবে পেয়েছে। এখন বুঝছে সে গৌরবের লাভ কি ছিল? সে জানে প্রাইমারীর রিটার্ন পরীক্ষায় কয়েকবার টিকেও ভাইভায় আউট হয়েছে কিভাবে।
নারী কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর পোষ্য কোটার সুবাদে তার চেয়ে কম মেধার মেয়েরা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা, কিছু শিক্ষকের সন্তানও অনায়াসে সরকারী চাকুরীতে ঢুকে পড়েছে। আর সাধারণ কোটা হওয়ায় অনেক মেধা অর্জন করেও চাকুরী পায়নি সে।
এসব কথা মনে হলে আগে প্রায় সময় দেশের প্রধানদের বুদ্ধিজীবিদের মনে মনে গালি দিত লাক্কু মিয়া। দীর্ঘদিন ধরে মহিলারা দেশের প্রধান হওয়ায় মহিলাদের সুযোগ সুবিদা দিতে দিতে এই অবস্থা তার।
এখন নাকী শতকরা পচানব্বই ভাগ প্রাইমারী স্কুলে পুরুষ টিচার নাই। মহিলারাই সব শরীর চর্চা, খেলাধুলা থেকে শুরু করে সব কিছুই করে। আবার ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি। আর এতে করে প্রাইমারী শিক্ষিকাদের এমন ভাব বেড়ে গেছে যেন একেক জন শিক্ষিকা একেক জন মিনিস্টার, সচিব, উপ-সচিব, মহাসচিব হয়ে গেছে। পায়ের উপর পা তুলে, বিছানায় শুয়ে বসে স্বামীকে পিএস, এপিএস সর্বপরি স্কুলের পিয়নের মতো যখন তখন অর্ডার করে। নানা অজুহাতে শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে মিথ্যাচার করে নিজের বিবাহিত স্বামীর দ্বারা কাপড়-চোপড় পর্যন্ত পরিষ্কার করিয়ে নেয়।
সরকারী চাকুরীজীবি বউয়ের এসব চালাকী বুঝতে পেরেও কিছু বলার থাকে না লাক্কু মিয়ার। প্রথম প্রথম কষ্ট লাগলেও এখন আর কষ্ট পায় না। ভাবে নিজের মহামূল্যবান ইজ্জত বিক্রি করেই তো অভিযোগহীন মানুষ হতে পেরেছে সে। তবে এখন আর নিজের ভাগ্যের উপর দোষ চাপায় না। যেকোন ভাবেই হোক একটি মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট জোগাড় করতে না পারা জন্মদাতা বাপের উপরও অভিযোগ নেই তার।
এখন আর কারো প্রতিই কোন অভিযোগ নেই লাক্কু মিয়ার। সে ভাবে আসলে টাকাই মানুষের আত্মমর্যাদা খেয়ে ফেলে।
মাঝে মধ্যে মনকে শান্তনা দেয়ার ভাষাও অবশিষ্ট থাকে না। বুকের পাজর ছেদ করা বউয়ের বাকা কথাও এখন আর আহত করতে পারে না তাকে। বউটাকে জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে হলেও কখনও সেই বউয়ের ভালোবাসায় সিক্ত হতে হয় নিজেকে।
মাঝে মধ্যে রাতে বেড়াতে তার নিজের ইচ্ছে না থাকলেও খুব আপন করে, খুব ঘনিষ্ট ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে আকতারি পারভিন। এখনও সোনা পাখি, ময়না পাখি বলে দুর্বল করার কৌশলটা ভালই রপ্ত করেছে আকতারি। লাক্কু মিয়া তখন উপায়ান্তহীন মানুষের মতো বউয়ের কৌশল মেনে নিয়ে যৌবনের রসে সব ভুলে যায়।
তবে আগে নিজের ইচ্ছে মতো আকতারি পারভিনকে আদর সোহাগ করলেও এখন আর সাহস হয় না। কখন ফোস করে উঠবে কে জানে। তাছাড়া আস্তে আস্তে বউকে মনিব ভাবত ভাবতে সে ইচ্ছেটাও মাটিতে মিশে গেছে। লাক্কু মিয়া এতোদিনে একটি বিষয় উপলদ্ধি করেছে সেটা হলো মানুষের ভালো লাগা না লাগার সাথে সাথেই যৌবনের চাহিদাটাও উঠা নামা করে। আর এজন্যই হয়তো বা সেক্সের কামনা-বাসনা তেমন কাজ করে না তার মধ্যে।
তবে এখন নিজের বিবাহিত স্ত্রী, ভালোবাসার পাখিটাকে নষ্ট মেয়ে, মাগী বলে মন হয় তার। মনে হয় কারো না কারো সাথে দৈহিক সম্পর্ক আছে আকতারি পারভিনের। তা নাহলে রাত জেগে জেগে ফেসবুকে চেটিং করতে যাবে কেন? নাইট ড্রেসে ইমোতে ভিডিও কলে কথা বলবে কেন? জীবন্ত স্বামীকে রেখে অন্য কোন পুরুষের সাথে এভাবে কথা বলবে কেন?
এরই মধ্যে বউয়ের চরিত্র হননের মতো অনেকগুলো প্রমাণও পেয়েছে লাক্কু মিয়া। রাত জেগে চেটিংয়ের ধরন, হালকা পোষাকের ফাঁকে ভিডিওতে দেহ দেখানোর কৌশল, মুখের বিভিন্ন ভঙ্গিমাই সে প্রমাণের স্বাক্ষ্য বহন করে।
নিজের বউকে অন্য কেউ সোনা-ময়না পাখি বললে, ইমোতে কিস দিলে কেমন লাগে সেটা সে ছাড়া আর কেউ ভালো বুঝতে পারে না। তবুও সন্তানের দিকে তাকিয়ে নিজের বউয়ের সাথে এক বিছানায় রাত যাপন করে এই অভিযোগহীন মানুষটি। এই ভেবে যে একজন পতিতার সাথে রাত যাপন করলেও টাকার প্রয়োজন হয়। সেখানে আকতারি পারভিনের মতো একজন উচু মানের, বড় মনের শিক্ষিত মহিলার বিছানায় বিনা পয়সায় শোয়ার ভাগ্য তার হয়েছে। অভিযোগহীন একজন বেকার মানুষেরতো এটাই বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার।
সমকালীন কবিতা ও বোধের কিছু দিগন্ত | গোলাম কিবরিয়া পিনু
কবিতা লিখি, পড়ি ও কবিতা নিয়ে বিভিন্ন বিবেচনায় বিভিন্ন সময়ে অনুরণিত হতে থাকি। এ-ধরনের অবস্থাটা কাঙ্ক্ষিত বলেই জীবনের সাথে তা সাযুজ্যপূর্ণ ও স্পন্দনশীল হয়ে বনহরিণীর মতন চঞ্চলতা নিয়ে স্থির থাকতে দেয় না; এর ফলে কবিতা সম্পর্কে বিভিন্ন বোধ জেগে ওঠে। এইসব বোধ ধারাবাহিকতায় খুব বেশি ব্যবধানে বিচ্ছিন্ন থাকে না, দড়িছেঁড়া অবস্থায় নিয়ে যায় না; তবুও এই মুহূর্তে সমকালীন কবিতার অনুষঙ্গ নিয়ে আমার কিছু বিবেচনা অল্প-খানিক দিগন্ত উন্মোচন করবে মাত্র কিন্তু আরও দিগন্ত গুপ্ত-সুপ্ত থেকে যাবে।
শুধু অনুভবে নয়, বাস্তব পরিধিতে অস্থিরচিত্ততা এ-সমাজে বেড়েছে বেশ, নির্লজ্জ নীতিহীনতার প্রকোপ ছোঁয়াচে রোগের মত ছড়িয়ে পড়েছে; বেদনাদীর্ণ হওয়ার পরও চিকিৎসা নেই। বিবেকতাড়িত হয়ে নীতিহীনতার বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা যেন দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কবিরাও দিকভ্রান্তিতে পড়ে যায়-কত রকমের ধান্দা চারদিকে, এরমধ্যে কবির নিজস্ব বোধ নষ্ট হতে থাকে, কবি নিজেও পচাগন্ধ পায়-তখন কবিতা নিয়ে কবির এগিয়ে চলার সাহস-স্পর্ধা লুপ্ত হতে থাকে। এভাবে কবির পতনমুখী এক ধরনের অবস্থান তৈরি হয়ে যায়-সেই পরিস্থিতিতে কবিতা উন্মুখ হতে পারে না, কবিতার অপমৃত্যু ঘটে।
এই সময়ে-টিভির বিভিন্ন চ্যানেল-এর ছবি ও অনুষ্ঠানের মাদকতায় টেনে নিচ্ছে মানুষকে, নেশাগ্রস্ত করে তুলছে। আবার আধুনিক হয়ে ওঠার দৌড়ে কম্পিউটার-ইন্টারনেট ও বহুবিধ যোগাযোগ ব্যবস্থায় পর্ণো-মানসিকতাও সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে সংবাদপত্রও পাঠক টানার কৌশলে যৌনতা, রাজনীতি, খুনখারাপি ও বিভিন্ন স্টোরীর নামে ভেদবুদ্ধির চালচিত্র গিলানোর জন্য মেতে উঠেছে। এইসব কর্মকাণ্ডে রুচিতে এক ধরনের বাণিজ্যিক চাহিদা ও উপযোগিতা তৈরি হচ্ছে-যাতে কবিতার অবস্থান দূরবর্তী বদ্বীপের মত হয়ে পড়ছে অনেকটা।
বর্তমানে কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এর জন্য শুধু কবিরা দায়ী নয়। এ-জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অন্যান্য কারণও রয়েছে, তবুও সচেতনভাবে কবিদের জন্য এই সংকট কবিদেরই মোকাবেলা করতে হবে। তবে-এ ক্ষেত্রে কিছু কবি বিশেষভাবে দায়ী-তারা ভাবেন, তারাই একমাত্র কাব্যবোদ্ধা! যে ভাবেই কবিতা লিখেন না কেন, আর সেই কবিতায় কোনো শিল্পশর্ত পূরণ হোক না হোক বা ধারাবাহিক অভিজ্ঞতায় সামঞ্জস্য থাক বা না থাক কিংবা কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা না হোক-তবুও এভাবে কবিতাকে এক ধরনের শূন্যতায় নিক্ষেপ করতে তারা ভালোবাসেন। এদের ভূমিকায় আজ কবিতা ও পাঠকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে।
পাঠক হিসেবে লক্ষ্য করি-বর্তমানে কোনো কোনো কবি আধুনিকতার নামে ও পরিবর্তনের নামে কবিতাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে বিভ্রান্তিমূলক পর্যায়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট। কেনো কেনো কবি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বিপর্যয়েরও সৃষ্টি করছেন, এরফলে কবিতা হয়ে উঠছে কবিতার নামে খণ্ডিত এক পদ্ধতি মাত্র। শুধু বাঁক পরিবর্তনের ইচ্ছে নিয়ে চলার নাম এক ধরনের স্বাধীনতা হতে পারে কিন্তু আধুনিকতা মূর্ত নাও হতে পারে-কবিতায়। আধুনিকতা সমাজবিচ্ছিন্ন বিষয় নয় : সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়নির্দেশক দর্শন-চেতনা। শুধু পরিবর্তনের স্থূল চালচিত্র নিয়ে আধুনিকতা চিহিৃত হতে পারে না। কবিতা সমকালীন হলেই-তা আধুনিক হবে, তা ঠিক নয়। শুধু কবিতার আঙ্গিক পরিবর্তন হলেই-আধুনিক কবিতা হয়ে ওঠে না-এরসাথে চেতনাগত বিষয়টিও যুক্ত। সমাজের মানসিকতা পরিবর্তনের ফলে কবিতার পরিবর্তন হয়, তবে কবিরা-সমাজের অগ্রসর মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয় বলেই তারা পরিবর্তিত চেতনাকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায় টেনে নিয়ে মানুষের চেতনাকে সমৃদ্ধ করেন বা নতুনভাবে মানুষের ভাবনাজগতকে নির্মাণ করেন বা মানুষের বোধকে ভিন্ন দ্যূতিতে উজ্জ্বল করেন।
বাংলা কবিতা শুধু নয়, বিশ্বের অন্যান্য ভাষার কবিতাও ধারবাহিকতা নিয়ে উজ্জ্বল হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা প্রবহমানেরই নামান্তর। কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর পরিধি বেড়েছে, তবে তার মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক ও সাযুজ্য থেকেই যায়। মানুষের জীবনও চলছে চেতনার প্রবাহ নিয়ে, এই প্রবাহ বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন পরিধিতে ব্যাপ্তি লাভ করলেও-অনেক ধারণা কাল পরিবর্তনের পরও একই থেকে যায়। কবিতার ক্ষেত্রেও এই ধরনের অপরিবর্তনীয় বিষয় ও শিল্পশর্ত লক্ষণীয়। যদি বলি- চর্যাপদ থেকে বাংলা কবিতার যে বিকাশ, সেই বিকাশের ধারায় সমকালীন বাংলা কবিতার অস্তিত্ব ও উজ্জ্বলতা। আর এই কারণে বাংলা কবিতার যে সম্ভাবনা তা অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বাংলা কবিতার যে বৈশিষ্ট্য ও ব্যঞ্জনা রয়েছে, সেই প্রবহমান শক্তিকে ধারণ করেই সমকালীন বাংলা কবিতার সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করতে হবে।
বিভিন্ন ধরনের কবিতার অস্তিত্ব থেকে যায়। আর এই বিভিন্ন ধরনের কবিতা শুধু সাম্প্রতিকালেই লেখা হচ্ছে না, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্নকালে তা লেখা হয়েছে। এ কারণে কবিতাকে একক সংজ্ঞা দিয়ে চিহিৃত করা সম্ভব নয়। তাই বলে-কবিতাকে পিঠমোড়া করে নিয়ে নৈরাজ্যের হাটে বেচাকেনা করাও সমীচীন নয়। কবিতা বহুবিধ সংজ্ঞার মধ্যে থেকেও ধারাবাহিকতায় এক ধরনের অন্তঃপ্রাণ নিয়ে বাঁচে, বেঁচে থাকবে। কবিতা বহুবিধ শৈলীর সমন্বয়ে অভিজ্ঞতা-অনুভূতি-আবেগ নিয়ে প্রাণ পায়। আর সেজন্য কবি মাত্রই জানেন-ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর বহুবিধ অলংকারের তাৎপর্য। তবে যান্ত্রিকতার বাইরে কবি মস্তিষ্কের বহুবর্ণিল অনুরণন প্রকৃত কবিতায় রূপ পেতে দেখি। যে কবিতা পাঠককে কাব্যরসে সিক্ত করে এক ভিন্ন শিল্পবোধে চঞ্চল করে তোলে, দোরখোলা মুক্ত দিগন্তে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত শুধু করে না, দর্শানুভূতিতে বিভিন্নমুখী তাৎপর্য সৃষ্টি করে, তখন তা প্রকৃত কবিতার উদাহরণ হয়ে ওঠে।
আশার কথা- সমকালীন কবিতায় ছন্দ শুধু গুরুত্ব পাচ্ছে না, মিলবিন্যাসের চমকপ্রদ ব্যবহারও আমরা লক্ষ্য করছি। ছন্দ ও মিলের যে এক ধরনের শক্তি রয়েছে- তা এখন শুধু প্রতীয়মান হচ্ছে না, পূর্বেও প্রতীয়মান হয়েছিল। বাংলা কবিতার (শুধু বাংলা কবিতা কেন, অন্য ভাষার কবিতায়ও লক্ষ্যণীয়) ধারাবাহিকতায় ছন্দের একটি শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। তাই বলবো- ছন্দের প্রত্যাবর্তন কবিতায় আসুক, আরও নিরীক্ষায় সংহত হোক। সত্তর-আশি বা পূর্বের কবিতায় ছন্দ যে একেবারে ছিল না, তা কিন্তু নয়। কবিতায় ছন্দ ব্যবহারে উদাসীনতা আমরা লক্ষ্য করেছি চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের কবিদের ক্ষেত্রে। সেই সময় থেকে বাংলা কবিতার বিভিন্ন পর্যায়ে ছন্দকে অগ্রাহ্য করে কবিতার অনেক মূল্যমানকেই নষ্ট করার মানসিকতা লক্ষ্য করা গেছে। পত্র-পত্রিকার প্রাচুর্য ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ছোট পত্রিকার আওতায় কাব্যচর্চার উন্নাসিক প্রবণতার ফলে কবিতা শুধু ছন্দের বিপরীতে দাঁড়ায়নি, বিভিন্ন অলংকারের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে, এর ফলে কবিতা শিথিল ও অনায়াস লেখনীর কসরৎ হয়ে দাঁড়ায়- এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। তবে বলবো না- ছন্দ ছাড়া কবিতা হয়নি বা হবে না কিংবা ছন্দেও ভাঙা-গড়া ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে না।
বিভিন্ন কবির কবিতায় বিভিন্ন বিষয় ও শৈলীর উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি। কবিতা স্পষ্ট-অস্পষ্ট, উচ্চকণ্ঠ-নিম্নকণ্ঠ, আখ্যানধর্মী-নাট্যধর্মী-লিরিকধর্মী ইত্যাদি রকমের হতেই পারে। পাঠকের সাথে কবির এক ধরনের যোগাযোগ স্থাপন করার উদ্দেশ্য থেকেই যায়- এই উদ্দেশ্য যে কোনো শিল্প মাধ্যমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে, সমকালীন কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্য হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যে কবিতা এককালে দুর্বোধ্য, তা পরবর্তিকালে বোধগম্য হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছে- রুচি, পাঠস্পৃহা ও অন্যান্য কারণে। কিন্তু বর্তমানে কিছু কিছু কবিতা লেখা হচ্ছে কবির বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে ও কবিতার সহজ প্রকাশ-সুযোগের জন্য; এমন কবিতা পাঠকের সাথে কাঙ্ক্ষিত সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না। এসব কবিতায় না আছে ভাবের সঙ্গতি, না আছে ছন্দের সঙ্গতি, না আছে অলংকারের সঙ্গতি, না আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গতি। এসব তথাকথিত কবিতার ফলে কবিতার পাঠক কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু পড়ছে না, কবিতা হয়ে উঠেছে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মধ্যে সবচেয়ে সহজলভ্য বস্তু। নিছক দুরূহতা ও অস্পষ্টতা নিয়ে কবিতাকে নৈরাজ্যের ভেতর ঠেলে দিয়ে কবিতার সম্ভাবনা ও মূল্যকে নষ্ট করা সমীচীন নয়। কবিতাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রূপকল্পে বিভিন্ন দ্যোতনা নিয়ে কবিতাকে উজ্জ্বল করার শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে কেউ কেউ বর্তমানে সৃজনমুখর, এমন কবিদের হাতেই সমকালীন কবিতার সম্ভাবনা বেশি।
কবিতা সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো শিল্পমাধ্যম নয়। তবে কবিকে সামাজিক দায় নিয়ে কবিতা লিখতে হলেও-তার সেই দায় পালনের সীমা কোন্ পর্যায়ে উপনীত হলে-কবিতার সৌন্দর্য নষ্ট হবে না-সেটা বুঝতে হবে। অন্যভাবে বলা যায় একটি কবিতা শিল্পশর্ত পূরণ করেই সামাজিক দায় বহনের শক্তি অর্জন করতে পারে। বাংলা কবিতার ধারায় কখনো কবিতা ধারণ করেছে বৌদ্ধ সাধনার বিষয়-যেমন চর্যাপদের দোহা, কখনো কৃষ্ণকথার শ্রীকৃষ্ণবিজয়, বৈষ্ণব পদাবলী, রামায়ণ-মহাভারত কিংবা বিংশ শতাব্দীর সময়ে মানুষের জীবন, সংগ্রাম, পরাধীনতা, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, নগরজীবনসহ সমাজের নানা পরিধির দিগন্ত। সমাজজীবন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কবিতায় রূপান্তর ঘটে। এই রূপান্তরের নব-নব সম্ভাবনাকে কবিতা ধারণ করে থাকে। কবির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে- কী দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি বর্তমানের সমাজ ও সামাজিক জীবনকে দেখবেন, সমাজের কোন্ পরতে তার কাব্য-আলো ফেলবেন, কোন্ জিনিসটি বর্জন করবেন বা বিকশিত করবেন। কবিতা মানুষের জন্যই- ভালো কবিতার শিল্প-সৌন্দর্য স্বতঃস্ফুর্ত ও আনন্দময় অনুভূতির জন্ম দিয়ে থাকে।
পাঠক হিসেবে সমকালীন কবিতা নিয়মিত পড়ি, পড়তে গিয়ে অনেক কবিতা ভালো লাগে, মনোরাজ্যে স্পন্দন জাগায় ও দৃষ্টিভঙ্গিকে শাণিত করে, সৌন্দর্যের আলোয় আবার ভিন্ন মাত্রার তাৎপর্য সৃষ্টি করে। আবার অনেক কবিতা পড়ে মনে হয়- নৈরাশ্যের অন্ধকার নিয়ে এসব কবিতা বিপর্যস্ত। কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয়-তা নির্ণয় করার মাপকাঠি আমরা অনেক ক্ষেত্রে হারাতে বসেছি- গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা ও পারস্পরিক পৃষ্ঠ চুলকানোর কারণে। তবে এইভাবে বাজার গরম হলেও- সৎ পাঠক, সৎ সমালোচক, সৎ সম্পাদক প্রকৃত কবিতাকে ঠিকই চিহ্নিত করেন। যুগে যুগে এভাবেই চোরাস্রোত থেকে উদ্ধার পেয়ে প্রকৃত কবিতা বেঁচে থাকে কল্লোলিনীর জলধারায়।
ড. গোলাম কিবরিয়া পিনু : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
হাইটালি | জুলকারনাইন স্বপন
কিছু কিছু স্মৃতি মানুষ অনেক দিন মনে রাখে বা সযত্নে লুকিয়ে রাখে মনের গভীরে। এমনকী সারাজীবন ধরেই বয়ে বেড়ায়। বিশেষ করে শৈশব, কৈশোরের স্মৃতিগুলো মানুষের মনে দাগ কাটে বেশি। আর শৈশব, কৈশোরের স্মৃতিগুলো হয় মূলত খেলার সাথি, নিজ গ্রাম বা তার আশপাশের মানুষগুলোকে ঘিরে। স্মৃতিগুলো মনে হলে এক অনাবিল শান্তিতে ভরে যায় মন। এক অপার্থিব ভালোলাগায় ভরে ওঠে হৃদয়। স্মৃতিগুলোকে মানুষ নিজের মতো করে ভালোবাসে। ভাবে, এটা শুধুই আমার।
এমন অনেক স্মৃতি আজও মনে পড়লে কাজলের মনটা চলে যায় অনেক দূরে। সেই শৈশব, কৈশোর এসে ভেসে ওঠে তার চোখের তারায়... সেই গ্রাম, যে গ্রামের ধুলোমাটিতে একসময় মাখামাখি হত তার সারা শরীর... সেই মেঠোপথ, যে পথের ঘাসের ওপর শিশিরবিন্দুগুলো টলমল করত... সেই গাছগাছালি, সেই পাখিরা, সেই নদী মনে হয় আজও তাকে কাছে ডাকছে।
হুতোমপ্যাঁচাগুলো কি এখনও গভীর রাতে ডেকে ডেকে বুকে ভয় ধরিয়ে দেয়? হাঁসগুলো কি এখনও খেলা করে নদীর জলে? গায়েন কাকা কি এখনও দোতারা হাতে আসর জমায়? নাকি তিনি আদৌ বেঁচেই নেই! করুণা মাসী কি এখনও মাছ ফেরি করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে? জয়নাল নানা কি ফোকলা দাঁত নিয়ে রসের গল্প বলেই চলছে?
জেলেপাড়ার মানুষগুলো কেমন আছে এখন? এখনও কি বেলবাজারের মেলা বসে... রঙিন মার্বেল...?
কাজলের শৈশবের বেশি অংশটাই কেটেছে গ্রামে। কিন্তু কৈশোর পর্যন্ত তার সাথে গ্রামের সম্পর্ক ছিল নিয়মিত এবং নিবিড়। সে তার গ্রামকে খুব ভালোবাসত যেমন সন্তান ভালোবাসে তার মাকে। আর ভালোবাসবে না-ই বা কেন! এই গ্রামেই যে তার জন্ম। এই গ্রামের আলো-বাতাসের সাথে তার শৈশব কেটেছে। আর যে নদীতে সারাদিন লাফালাফি করে তার চোখ লালবর্ণ ধারণ করত, শেষে মায়ের হাতের পিটুনি জুটত, সেই নদীকে ঘিরেই কাজলের গ্রামের অবস্থান। সেই নদীর ওপর অনেকাংশে নির্ভর করত এই গ্রামের মানুষগুলো।
গ্রামের নাম সুবর্ণপুর। যেমন নাম তেমনই সুন্দর গ্রামটি। ঝকঝকে তকতকে ছিল প্রতিটি উঠোন, কিন্তু অন্য দৃশ্যও ছিল; সেটা অবশ্য জেলেপাড়ার। শহর থেকে অনেক দূরে সুবর্ণপুর। একটি বড়ো রাস্তা এসে সুবর্ণপুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে অন্য একটি হাটে। এই রাস্তা দিয়ে এক হাঁটু ধুলা মাড়িয়ে গাড়োয়ানরা মালবোঝাই গরুর গাড়ি হাঁকিয়ে হাটে যেত। তাদের কণ্ঠে থাকত ভাওয়াইয়া গান... ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত চলিম মুই পন্থে পন্থে রে... কিংবা ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে, কোনদিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও, কয়া যাও রে...। আশপাশের বাড়ির বউ-ঝিরা গান শুনে ঘোমটার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখত। গাড়োয়ানদের উদাস কণ্ঠের সেই গান যুবতীদের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলত। সেই অজানা, অচেনা গাড়িয়ালের ব্যথাতুর কণ্ঠের সুর তাদেরকেও ব্যথিত করে তুলত। তাদের ভাবনার জগতে গাড়িয়াল এক গভীর ছাপ ফেলত। ফলে তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত অজানা গন্তব্যের দিকে।
বড়ো রাস্তার পাশ ঘেঁষে সুবর্ণপুর গ্রাম। চওড়ার চেয়ে লম্বার দিকেই বেশি বিস্তৃত। সুবর্ণপুর গ্রামের পর কিছুদূর আবাদি জমি। কোনো বাড়িঘর নেই। তারপর জেলেপাড়া। যদিও জেলেপাড়াকে সুবর্ণপুর গ্রামেরই অংশ ধরা হয় তথাপি কেমন করে যেন জেলেপাড়া নিজেকে আলাদা করে ফেলেছে। জেলেপাড়ার কিছু বৈশিষ্ট্যই হয়তো বা জেলেপাড়াকে স্বতন্ত্র একটি রূপ দিয়েছে।
জেলেপাড়ার প্রতিটি বাড়ি ঝুপড়ির মতো নিচু, কোনোরকমে মাথা হেঁট করে ঘরে ঢুকতে হয়। আর ঘরের ভেতরে ঢুকলেই মনে হবে আলো-বাতাসহীন এক বিভীষিকাময় অন্ধকার কূপে যেন ফেলে দেয়া হয়েছে। দম বন্ধ হয়ে আসে স্বল্প পরিসরের সেই ঘরে। এই ঘরেই অনেকগুলো মানুষ একত্রে ঠাসাঠাসি করে বাস করে বছরের পর বছর, জীবনভর। একটি বাড়ি ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে আরেকটি বাড়ি দাঁড়ানো। অবশ্য বাড়ি বললে ভুল হবে, কোনোরকমে একটি চালাঘর। রান্নাবান্না হয় বাইরে, খোলা আকাশের নীচে। সকাল-সন্ধ্যায় প্রতিটি বাড়ির সামনে বাঁশ গেড়ে জাল শুকোতে দেয় তারা। ফলে জেলেপাড়াটি জালের বেড়া দ্বারা ঢেকে যায়। বাড়ির পেছনটা তারা কলাপাতা দিয়ে আড়াল করার বৃথাচেষ্টা করে। ফলে ঐ কলাপাতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে দিনে রাতে কুকুর-শেয়াল অনায়াসেই যাতায়াত করে। জেলেপাড়ার বাড়িগুলো পাশাপাশি থাকলেও একটি ঘর জেলেপাড়া থেকে দূরে যেন শূন্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের বাইরে যতটা না শূন্যতা তার চেয়ে বেশি শূন্যতা ঘরের ভেতরে। ঐ ঘর বা বাড়ির চারপাশে কোনো আড়াল নেই। চারদিকই খোলা। সুনসান। এই শূন্যতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ঐ বাড়ির পরের ধু ধু বালুচর। আর কোনো গ্রাম নেই, নেই কোনো প্রাণের স্পন্দন। করুণা মাসী এক অসীম শূন্যতা নিয়ে এই ঘরেই বাস করে। একলা। বিধবা। স্বামী মারা গেছে সাপে কেটে। জেলেরা যে মাছ ধরে, সেই মাছ নিয়ে করুণা মাসী বাড়ি বাড়ি ফেরি করে। কখনো নগদ পায়, আর বেশিভাগই ধানচালের বিনিময়ে। সেই ধানচালগুলো সে বিক্রি করে সুবর্ণপুর হাটে। করুণা মাসী জেলেপাড়ার যে প্রান্তে থাকে, তার অপর প্রান্তে কিছুদূর এগোলেই নদীটা যেখানে সোজা পুবদিকে বাঁক নিয়েছে, সেখানেই সুবর্ণপুর হাট।
সুবর্ণপুর হাট বসে শনিবার আর মঙ্গলবার। এই গ্রাম ছাড়াও আরও দু-এক গ্রামের লোকজন তাদের প্রয়োজনীয় খরচাপাতি করে এই হাট থেকেই। সুবর্ণপুর হাট খুব একটা বড়ো নয়। স্থায়ী দোকানপাট নেই বললেই চলে। একটি মাত্র দোচালা দোকান আছে, যার মালিক বয়তুল্লা। হাটবার ছাড়া দিনে দোকান খোলা থাকে না। সন্ধ্যার পরে কুপি জ্বালিয়ে দু-এক ঘণ্টার জন্য খোলা হয়। দোকানের সামনে বাঁশের ফালি দিয়ে একটি টং পাতা হয়েছে। সন্ধ্যায় যারা পান খেতে বা বিড়ি ফুঁকতে আসে, তারা এই টঙে বসে আড্ডা মারে, গল্প-গুজব করে। মাঝে মাঝে গায়েন কাকা এসে দোতারা হাতে গানের আসর জমায়। হাটের দিন অবশ্য সারা এলাকা জুড়ে দোকান বসে। কেউ বা মাদুর পেতে, কেউ বা খড় বিছিয়ে কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে হরেক রকম জিনিসের পসরা নিয়ে বসে। কেউ খেতের সবজি, ধান, চাল-ডাল, কেউ হয়তো তামাকপাতা, পানপাতা দিয়ে পসরা সাজায়। লবণ থেকে শুরু করে মাছ পর্যন্ত এই হাটে পাওয়া যায়, শুধু মাংস ছাড়া। গামছা, লুঙ্গিও বিক্রি হয় এই হাটে। বাপের হাত ধরে যে ছেলেটি হাটে আসে, তার চানাচুর, মোয়ামুড়ি বা গুড়ের জিলাপির আবদারও রক্ষা হয় এই হাটে। কেউ বা ভাঁড় সাজিয়ে, কেউ নৌকা করে মালামাল নিয়ে আসে। হাটের দিন, বিশেষ করে মঙ্গলবারের হাটের দিনে গ্রামে একটা সাজ সাজ রব তৈরি হয়। কামার, কুমার, জেলে, কৃষক সবাই দুপুর হতেই কাজ ছাড়ে। প্রস্তুতি নিতে থাকে হাটে যাবার।
সুবর্ণপুর হাটের এক পাশে বিরাট এক বটগাছ। বটগাছটি তার শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত করে ছাতার মতো দাঁড়িয়ে আছে। বটগাছ থেকে কিছু লতা এসে মাটিতে গেঁথে বসেছে। সেগুলোই এক-একটি পিলারের মতো। হাটের অপর পাশে জেলেপাড়া লাগোয়া বিরাট এক কালীমন্দির। তেরো হাত লম্বা এক কালীমূর্তি স্বমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। কালীমন্দিরের পাশেই বিরাট লম্বা এক শিমুল গাছ তার দম্ভ নিয়ে আকাশ ছোঁয়ার অপেক্ষায়। তার দম্ভকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক জোড়া টিয়েপাখি। গাছের কোটরে বাসা বেঁধেছে তারা। সকাল-সন্ধ্যা হইচই, ঝগড়াবিবাদ করে এলাকাটা সরগরম করে রাখে। কালীপুজোর সময় সুবর্ণপুর হাটসহ মন্দির চত্বর এলাকায় মেলা বসে, যার নাম বেলবাজার। পুজোর সময় হিন্দুরা এখানে মানত করে কবুতর, পাঁঠা বলি দেয়। তখন দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসে।
এই মেলার জন্য গ্রামের মানুষ সারাবছর তাকিয়ে থাকে। যার যা প্রয়োজন তার সবকিছুই এই মেলায় পাওয়া যায়... আটা-চালা চালুনি থেকে দাদিমার সুপারি পেষার উড়–ন, ডালি, কুলা, হাঁড়িপাতিল, রসুন, মসলা... পরানবাবু বছরে একবার ধুতি কেনেন, তাও এই মেলায়... নাকের নথ, মাথার টিকলি, লালফিতা, নীলফিতা, লাঙলের ফলা, দা, কুড়াল, পাটের ছিকাই- স-ব। লাল-নীল রঙের মার্বেলের আকর্ষণে ঘুম ধরে না যে ছেলেটির, তার মুখে হাসি ফোটে মেলায় এলে। আর কত রকমের খাবারদাবার। মিষ্টি, গজা, তালমিছরি, বাতাসা, তিলের খাজা, খোরমা ইত্যাদি। গ্রামের কিশোরী মেয়েরা মেলায় আসে দল বেঁধে। আনাড়ি হাতে মা-বোনের রঙিন শাড়ি পরে কোনো কারণ ছাড়াই খিলখিল করে হাসতে হাসতে তারা মেলায় আসে। রঙিন চুড়ি, কোমরের বিছা, আয়না, তিব্বত স্নো তারা কিনবেই। এই মেলার সময় সুবর্ণপুরসহ আশপাশের গ্রাম সরব হয়ে ওঠে। জেলে তার জাল ছাড়ে, হালুয়া তার হাল ছাড়ে। সবাই এক উৎসবে মেতে ওঠে।
সুবর্ণপুর গ্রামসহ চারপাশের গ্রামের মানুষজনের জীবনযাপন, জেলেদের জীবিকানির্বাহ, উৎসব সবকিছু যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় সে আর কেউ নয়- হাইটালি। একটি নদী। শাখানদী। একসময় যৌবনকালে দু-কূল ছাপিয়ে জল উছলিয়ে পড়ত। শুকনো মৌসুমে পানির স্তর নেমে যখন প্রায় হাঁটু-সমান হত, তখন মানুষ নৌকা ছাড়াই এপার-ওপার করত হেঁটে হেঁটে। কাপড় না ভিজিয়েই এই নদী তখন পার হওয়া যেত। সেই থেকেই এই নদীর নাম হয়ে যায় হাইটালি।
হাইটালির পানি দিয়েই এলাকার চাষাবাদসহ সকল কাজ হয়ে থাকে। জেলেরা ডিঙি ভাসিয়ে মাছ ধরে সকাল-বিকাল-রাতে। সেই মাছ বিক্রি হয় গ্রামে গ্রামে, হাটে হাটে। এই নদীতেই ডিঙি ভাসিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে যায় দূর থেকে বহুদূরে। কখনো দুই দিন, কখনো তিন দিন তারা ডিঙিতেই থাকে, খায় দায়। এই হাইটালি যোগান দেয় অনেকগুলো মানুষের জীবন বাঁচার রসদ। চাষিরা সকালবেলা এই নদী পার হয়ে ওপারে যায় ক্ষেতে কাজ করতে। আবার ফসল তুলে ডিঙি দিয়ে নিয়ে আসে এপারে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ডাঙায় গোল্লাছুট, ছি-বুড়ি খেলে যতটা না আনন্দিত হয়, তার চেয়ে বেশি মজা পায় হাইটালির পানিতে দাপাদাপি করে। তারা শাপলা-শালুক তোলে পরম আনন্দে, ছিপ দিয়ে মাছ ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গাঁয়ের বউ-ঝিরা কাপড় কাচতে এসে উদাস হয়ে বসে থাকে হাইটালির পাড়ে। শেষে অবেলায় গোসল সেরে ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফিরে শাশুড়ি অথবা মায়ের বকুনি। রাখালরা তাদের গরু-ছাগলকে পানি খাওয়ায় এই নদীতে। তারপর সেগুলোকে গোসল করিয়ে গাঁয়ের পথ ধরে। সকালবেলা থালাবাসন মেজে কলসিতে পানি ভরে ঘোমটার ফাঁকে এপাশ-ওপাশ দেখতে দেখতে চঞ্চলা হরিণীর মতো চলে যায় নতুন বউ। এই হাইটালিই পানির যোগান দেয় এই অঞ্চলের অধিকাংশ প্রাণীকুলের। নৌকায় পাট বোঝাই করে মাঝিরা গান গাইতে গাইতে চলে যায় কোনো এক হাটে বা বন্দরে।
কিন্তু সেই হাইটালি এখন যৌবন পেরিয়ে পড়তি বয়সে। বয়সের ভারে সে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণকায় হয়েছে। তার প্রাণ জল, সেই জল আর প্রবাহিত হয় না তার বুক চিরে। সে বুকে এখন জেগেছে চর। শুকনো বালুচর। সে বালুচরে না জন্মে ঘাস, না জন্মে ফসল। কাজল কি জানে হাইটালির এই করুণ পরিণতি? সে কি শুনতে পায় তার হৃদয়ের কান্না? হাইটালির তীব্র আর্তনাদের কথা কাজল কি জানে? সে কি অনুভব করতে পারে হাইটালির কষ্টের তীব্রতা? হাইটালির কান্না, আহাজারি ভেসে বেড়ায় এখন সুবর্ণপুর গ্রামের আকাশে-বাতাসে। হায় হাইটালি...!
কামরুজ্জামান কামু'র কবিতা
আমাকে এবার পিছমোড়া করো
আমাকে এবার পিছমোড়া করো
চোখ বেঁধে ফেল প্রভু
আমি কোনোখানে কোনো মানুষের
হৃদয় দেখিনি কভু
আমি শুনি নাই কম্পিত রাতে
কোনো প্রহরীর হাঁক
আজি বসন্তে কালো কোকিলের
তীক্ষ্ণ মধুর ডাক
অন্ধকারের বুক থেকে এনে
চয়িত শব্দমালা
বসিয়েছি শুধু কবিতার দেহে
উদ্গীরনের জ্বালা
আমাকে এবার গুলি করো প্রভু
পাহাড়ে ও সমতলে
আমার শরীর লুটায়ে পড়ুক
কালো যমুনার জলে
আমিই সালাম আমি বরকত
আমি রফিকের ভাই
লেখামাত্রই আমার কবিতা
লাল হয়ে গেল তাই
এই মাঠঘাট এই বন্দর
এই মানুষের সারি
হে অবদমিত পৃথিবীর বুকে
উন্মুল নরনারী
এই বুকফাটা কান্নার রোল
আকাশপাতাল ধ্বনি
নিজ হাতে আমি খুবলে তুলছি
নিজের চোখের মনি
শত গোয়েন্দা দৃষ্টির ফাঁদ
সহস্র বন্দুক
নস্যাৎ করে সম্মুখে এসে
পেতে দিয়েছি এ বুক
আমিই সালাম আমি বরকত
আমি রফিকের ভাই
লেখামাত্রই আমার কবিতা
লাল হয়ে গেল তাই
পৃথিবীর বুকে আমি সেই কবি
আমি সেই চন্ডাল
আমি সেই লোক কালো ও বধির
আমার রক্ত লাল
আমি সন্ত্রাসী আমি ধর্ষক
আমি ধর্ষিত নারী
আমি তোরই ছেলে বুকে তুলে নে মা
ফিরেছি নিজের বাড়ি
হৃৎপিণ্ডের ঢিপঢিপ ধ্বনি
চঞ্চল রক্তের
ফিনকির মত ছিটকে বেরিয়ে
দেহে ফিরে আসি ফের
করি লেফটরাইট গুম করি আর
গুম হয়ে যাই নিজে
শুষ্ক রজনী কাষ্ঠ দিবস
ঘেমে উঠে যায় ভিজে
নিজের রক্ত নিজে পান করি
নিজ দংশনে নীল
নেশায় মত্ত মদের পাত্র
হয়েছে আমার দিল
আমাকে তোমার মনোরঞ্জনে
রঞ্জিত রাত্রির
কিনারায় নিয়ে ধর্ষণ করো
ধ্বস্ত করো হে নীড়
তনুর মায়ের শূন্য বুকের
মহাশুন্যতা হয়ে
বোবা পৃথিবীর বায়ুসম আমি
চিরকাল যাব বয়ে
কালোত্তীর্ণ কালের কান্না
হে মহাকালের মাটি
আমি রবীন্দ্র আমি নজরুল
ধরণীর বুকে হাঁটি
কেঁপে কেঁপে উঠি শিহরিত হই
পায়ের তলার ঘাসে
মরা কোষগুলি জৈবপ্রেষণে
চিৎকার করে হাসে
সংক্ষুব্ধের সংহার সম
শঙ্কিত এই রাতে
জন্ম দিয়েছি কোরবানি তোকে
করব রে নিজ হাতে
আজানের ধ্বনি ভেসে এলো ওই
পাখিদের কলরবে
একটিমাত্র গুলির আঘাতে
আমার মৃত্যু হবে
একটিমাত্র চিৎকার আজ
করব ভূমণ্ডলে
আমি বরকত সালাম রফিক
মরব মায়ের কোলে
আমাকে এবার পিছমোড়া করো
চোখ বেঁধে ফেল প্রভু
আমি কোনোখানে কোনো মানুষের
হৃদয় দেখিনি কভু
শুধু যুদ্ধের গোলা-বারুদের
শুধু হিংসার বাণী
প্রলয়ঙ্করী পৃথিবীতে কাঁপে
বেদনা-লতিকাখানি
শেষ নিশ্বাস এতো ভারী কেন
অসহ জগদ্দল
চারিদিকে মম ঘোরাফেরা করে
নায়কের মত খল
চারদিক কেন চেপে আসে আরও
চারিদিকে বন্দুক
গুলির শব্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে
বাংলাদেশের বুক
সময় নষ্ট
সময় নষ্ট কোরো না তো আমি
অফিসে যাব রে বাবা
কত কত আমি নর আর নারী
কত সিরিয়াস কত কারবারি
রাষ্ট্রযন্ত্র তন্ত্রমন্ত্র
জাহাজ বেচিয়া আদার ব্যাপারী
আদা হতে জল আলেদা করিয়া
তিলটিকে আমি তালগাছ ভ্রমে
আগায় চড়িয়া বসেছি
কবিতা কবিতা কোরো না তো আমি
ঘড়ি পড়ে গেল খুলিয়া
পড়িমরি যেন কারে ধরি কেন
ওয়ানা বি ওয়ানা বি হেন
আমেরিকা যাব সুইট যার ল্যান্ড
যাব কঙ্গো যাব সিরিয়ায়
ব্রিটেন-চায়না-আটোয়ারি-বোদা
দৌড়াতে হবে সদাসর্বদা
অফিসে যাব রে বাবা
ময়না
ধানক্ষেত যদি পার হয়ে যাই
কী হবে বল তো, ময়না
উৎখাত হই? এখানে বৃষ্টি
আদিকাল থেকে হয় না
এখানে সৃষ্টি হয় না তেমন
বিস্ময়কর বাণী
খাঁ খাঁ রোদ্দুর ফাটা প্রান্তর
মরে যাব আমি, রাণী
তৃষ্ণায় ফেটে চৌচির হয়ে
খ্রিষ্টীয় কোনো অব্দ
প্রেয়সীর বুকে গম্ভীর নাদে
হলো আজ নিস্তব্ধ
এই বঙ্গীয় সমাজের শত
মানবীয় আখ্যানে
তোমারে তো আমি আরাধনা করি
আমার কবিতা-গানে
নিশান | রানা ভিক্ষু
শহরে এসে খাবার হোটেলে মেসিয়ারের কাজ পেয়েছে হামিদ। এটো টেবিল মোছা তার কাজ। সকাল থেকে রাত দাঁড়াবার জো নাই। প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠতে হয়। পরাটার জন্য বানানো ডাল দিয়ে গরম ভাত, এই হলো প্রতিদিনের সকালের নাস্তা। ভাতের সাথে মাছ ও মাংসের জন্য বানানো কৃত্রিম ঝোলের সাথে সবজি অথবা ভুনা ডিম দিয়ে দুপুরের খাবার। আর বেশিরভাগ রাতে খাওয়ার রুচিই থাকে না হামিদের। মধ্যরাতে হোটেলের সাঁটার বন্ধ করা হলে পেট ভরা গ্যাসের ঢেকুর তুলতে তুলতে হামিদ ঘুুমাতে যায় টেবিল জোড়া লাগিয়ে। এই খাওয়া ও থাকার খরচ কেটে নিয়ে মাসে সাতশ’ টাকা বেতন পায় হামিদ।
শুধু হামিদ নয়, সেকেন্দার, রব্বানী, কালু, জাহাঙ্গীর, কেকারু মিলে পাঁচজন হোটেলেই রাত কাটায়। তবে সব থেকে জুনিয়র হামিদ। হামিদ যেদিন এখানে কাজ শুরু করেছে তার ক’দিন পরেই অদ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটলো তার স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবনে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে কয়েকজন এসে প্রত্যেককে একটি করে সাদা গেঞ্জি আর একটি করে লাল ‘নিশান’ দিল। বলল- এগুলো পরে কাল মিছিলে যেতে হবে। দুপুরে আলোচনা সভা হবে, সভা শেষে গান। সভায় বক্তৃতা দিতে ঢাকা থেকে কে যেন আসবেন, অতিথির নাম-পদবি গেঞ্জি ও নিশান বিতরণকারী লোকগুলোও জানে না। সবার কাছ থেকে চাঁদা ধরা হলো পঞ্চাশ টাকা। হোটেল মালিক চাঁদা পরিশোধ করে দিল, সবার বেতন থেকে কেটে রাখার শর্তে।
হামিদ জানে না কিসের মিছিল। ওদের মধ্যে কালু স্কুলে পড়েছিল। গেঞ্জির বুকে লাল রঙে লেখা ‘মহান মে দিবস’ কথাটি তার মুখেই শুনলো হামিদ। কথাটির অর্থ কী, কেন মিছিল, কেন গান এসবেব কিছুই জানে না সে। অন্যদের কাছে যা শুনল তার সারমর্ম হলো- ‘এদিন বেশ আনন্দ হয়। সাদা-গেঞ্জি আর লাল-নিশান পাওয়া যায়। ট্রাকে তুলে মিছিল করতে করতে নিয়ে যায় আলোচনাসভায়। সভা শেষ হলে খিঁচুরি খাওয়ায়। সন্ধ্যায় হয় গান। এদিন কোনো কাজ করতে হয় না।’
এসবের কোনো কিছুই অর্থবহ হলো না হামিদের কাছে। গ্রামে সে একবার মিছিল দেখেছে ভোটের সময়। মিছিলের সামনে ছিল এক ছোকরা। সারা শরীরে গাছের পাতা ঝুলিয়ে নানা ভঙ্গিমায় সে নেচে নেচে চলছিল। ভাঙা প্লেট বা পাতিল, যে যাই পেয়েছে তাতে গাছের ডাল কিংবা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঝনাৎ-ঝন্ শব্দ তুলে গ্রামবাসীরা ছোকরার পিছে পিছে সারা গ্রাম ঘুরেছে। দু’জন লোকের হাতে ছিল বাঁশের লাঠি। লাঠির মাথা ঝাজরা করে মাটির ‘সারোয়া’ শক্ত করে বাঁধা হয়েছিল। সারোয়া তে ছিল কিরোসিনে ডোবানো পাটের ‘হাপাল’। দাউদাউ করে আগুন জ¦লছিল হাপালে। ভাঙা প্লেটে একই তালে ঝনাৎ-ঝন্ শব্দের সাথে সবাই চিৎকার করে বলছিল- ‘মশাল’, ‘মশাল’, ‘মশাল’.....। সে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই ছিল খালি গা। মিছিল যেদিকে যাচ্ছিল, সেদিকের বাড়ি থেকে, মাঠের কাজ ফেলে রেখে লোকজন সামিল হচ্ছিল মিছিলে।
আর ‘আলোচনা সভা’ কি, তা হামিদ জানে না। তবে একবার ওদের গ্রামের স্কুল-মাঠে রাতে বায়োস্কোপ দেখানো হয়েছিল। বায়োস্কোপে সে একজনকে কাঁদতে দেখেছে। লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল উঁচু জায়গায়। সামনে লাখ লাখ মানুষকে পিঁপড়ের মতো দেখা যাচ্ছিল বায়োস্কোপে। সবার হাতে ছিল লাঠি। কয়েকজনের সাথে দাঁড়িয়ে লোকটি বলছিল- ‘‘ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি...’’। লোকটি কিছু কথা বলে আর চশমা খুলে চোখের পানি মুছছিল। হামিদ তার কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারেনি। কিন্তু হামিদেরও গলার ভেতর কু-লি পাকিয়ে কান্নার উপক্রম হয়েছিল।
তাহলে কালকে হামিদকে কি সেখানেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কিন্তু তাদের গ্রামের ভোটের মিছিলে কিংবা বায়োস্কোপের জনসভায় অংশীজনদের সবাইকে সাদা-গেঞ্জি, লাল-নিশান তো পরতে দেখেনি হামিদ। আবার দুপুরে খিঁচুরি খাওয়ানো, রাতে গান, এসবের কোনো কল্পচিত্র আঁকতে পারল না হামিদ। তবে সে খুবই উৎসুক। ভোর হয়েছে ভেবে রাতে দুই-তিনবার ঘুম ভেঙে গেল। সকালের আগেই সবাই গোসল সারলো। নতুন গেঞ্জি পড়ল, মাথায় বাঁধলো লাল ফিতে। কিন্তু গেঞ্জিটি হামিদের হাঁটু পর্যন্ত নেমে আসলো। মনটা খনিক খারাপ হলো তার। বোতাম ছেঁড়া ময়লা জামাটি গায়ে দিল হামিদ, মাথায় শক্ত করে বাঁধলো লাল নিশান। সবার সাথে সেও ট্রাকে উঠল। ট্রাক গিয়ে থামলো একটা চৌরাস্তা মোড়ে। সেখানে সে একজনের বিরাট আকারের ছবির দেয়াল দেখতে পেল। লোকটাকে তার চেনা মনে হলো খুব। এই শহরে আসার পর এই প্রথম একজন চেনা মানুষের নাগাল পেল সে। তবে ইনি কে তা মনে করতে পারছে না হামিদ। অনেক চেষ্টা করে হামিদের মনে পড়ল- হ্যাঁ ইনিই সেই লোক, যাকে সে বায়োস্কোপে দেখেছিল।
কালু’র কাছে জানতে পারল এনার নাম ‘বঙ্গবন্ধু’। সেদিন থেকে কারো মুখে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটি শুনলে হামিদের মনে হয়- এই শহরে অন্তত একজন ব্যক্তি আছেন, যাকে সে চেনে। হামিদ প্রায়ই মনে মনে ভাবে শহরে নিশ্চয়ই সে কোনোদিন ‘বঙ্গবন্ধু’র সাথে দেখা পাবে....। হঠাৎ ট্রাক স্ট্রাট করলে কে যেন একজন চিৎকার করে বলে- ‘দুনিয়ার মজদুর’......। সবাই তার জবাবে কী যেন বলল। হামিদকে চুপচাপ থাকতে দেখে কালু তাকে কিছু স্লোগান শিখিয়ে দিল। যখন নেতা বলবে- ‘দুনিয়ার মজদুর’, তখন তাকে বলতে হবে- ‘এক হও, লড়াই করো’। নেতা যখন বলবে- ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’, তখন বলতে হবে- ‘লড়াই করে জিততে চাই’। নেতা বলবে- ‘এই লড়াইয়ে জিতবে কারা’, বলতে হবে ‘কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা’। কয়েকবার বলতে বলতে স্লোগান রপ্ত হয়ে গেল হামিদের। গলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে স্লোগান দিচ্ছে। অনেক কথার অর্থ সে বোঝে না ঠিকই কিন্তু রক্ত যেনো তার টগবগ করে উঠছে!
দুপুরে ট্রাক পৌঁছালো বিশাল এক জনসমুদ্রে। সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না হামিদ। চতুর্দিকে মাইক বাজছে। যিনি কথা বলছেন তার কণ্ঠস্বর এমন, যেন মাইক না-থাকলেও কথা শোনা যেত। মাইকের শব্দে বিরক্ত হলো হামিদ। তাছাড়া এত লোক বক্তার মুখই দেখা যাচ্ছে না। মাঠের শেষদিকটায় তারা দাঁড়িয়ে ছিল। পাশে একটা বট গাছ। অনেকে গাছে উঠে মঞ্চের লোকজনকে দেখছে। হামিদও তরতর করে উঠে একটা মোটা ডালে বসল। বড় একটা লাল ‘চকি’র মধ্যে বসে আছে জনা কুড়ি লোক। চকির পেছনে লাল কাপড়ে কাস্তে, হাতুরি আর মুষ্টিবদ্ধ হাতের ছবি আঁকা। সবার গায়ে সাদা-গেঞ্জি আর মাথায় ও হাতে লাল-নিশান বাধা। একজনের পর আরেকজন উঠে উঠে কথা বলে আবার চকি’র উপর বসছে। হামিদ তাদের কথার মাথা-আগা কিছু বুঝছে না। উপরন্তু মাইকের বিকট শব্দে কানো ভো ভো ছাড়া কোনো অর্থবহ শব্দ পাচ্ছে না। তার চোখে ভাসছে তার নিজ গ্রাম ‘ঢিংটারী’র বিশাল কদম গাছটির কথা। বাদুর ঐ গাছের কদম যতটা খায়, তার দশগুন বেশি খায় গ্রামের ছেলেমেয়েরা। চোখ বন্ধ করে সেই কদমের স্বাদ আর গন্ধ পাচ্ছে হামিদ। দেখতে পাচ্ছে ছোটো বোন ‘পারুল’সহ তোতা, দুলু, বিষ্ণু, ইলিয়াস, মানিক, শংকর, আমিন, মালতি, কাজলা ... সবাইকে।
একসময় লাল-চকি থেকে লোকজন নেমে গেল। চকিতে উঠেছে আরেক দল মানুষ। তাদের হাতে অনেক কিছু। হামিদ কেবল ঢোল আর হামমোনিয়ামটাই চিনলো। তবে এখানকার ঢোলগুলো কমন যেন ছোটো ছোটো। ঘাড়ে না ঝুলিয়ে টেবিলে বসিয়ে ঢোল বাজানো দেখে বেশ মজা পেল হামিদ। একজনের হাতে মাছ ধরা ‘ডারকি’র মতো একটা যন্ত্র। মহিষের শিংয়ের মতো লম্বা লম্বা তিনটা বাঁশি তিনজনের হাতে। ‘তুম্মা কদুর বস’ এর মতো তিনটা খোল নিয়ে একটা লোক যাদুকরে মতো পটাপট বাজাচ্ছে। এখন হামিদের কিছুটা ভালো ভাগছে। খাটো করে এক লোক লম্বা চুল দুলিয়ে গান ধরলো- ‘চম্পা ফুটিলো চামেলি ফুটিল, তার সুবাসে ব্যাকুল এমন নাচিলো রে...। হামিদ হঠাৎ খেয়াল করল অনেকেই মাঠ থেকে চলে যাচ্ছে। হামিদ নিচে তাকিয়ে ‘সেকেন্দার, রব্বানী, কালু, জাহাঙ্গীর, কেকারু’ ছাড়াও হোটেলের অন্য ছেলেদের কাউকে দেখতে পেল না। হামিদের গা শিউড়ে উঠল। সে এখন কার সাথে ফিরবে?
একবার সে বেতগাড়ি হাটে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। পরে বুদ্ধি খাটিয়ে ‘ঢিংটারি’ যাওয়ার রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রামের অনেক লোকের দেখা পেয়েছিল। কিন্তু এখানে যেসব রাস্তা এই বিশাল মাঠে মিলে গেছে, সেগুলোর সবগুলোকে একইরকম মনে হলো হামিদের। মাঠ থেকে বেড়ানোর আটটি রাস্তা খুঁজে হামিদ আরো দিকভ্রান্ত হয়ে গেল। কোনপথে পা বাড়াবে সে? এবার সে অন্য আরেকটা বুদ্ধি খাটানোর চেষ্টা করলো। যে ট্রাকে এসেছে সেই ট্রাকটিকে খুঁজলো। কিন্তু ট্রাকগুলোও তো দেখতে একইরকম! আন্দাজ করে একটি ট্রাকে উঠে পড়ল সে।
রাত এগারোটায় ট্রাক শহরে এসে বিভিন্ন মোড়ে দাঁড়িয়ে লোকজনকে নামিয়ে দিল। কিন্তু কোনো মোড়ই হামিদের পরিচিত নয়। বঙ্গবন্ধু’র প্রতিকৃতি ছিল যে মোড়ে সেটিও চোখে পড়ল না। কাঁদতে শুরু করলো হামিদ। ট্রাকের হেলপার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে নিজের নাম ‘হামিদ’ আর গ্রামের নাম ‘ঢিংটারী’ ছাড়া কোনো উত্তরই দিতে পারলো না। তবে সে সব খুলে বলল- চার দিন আগে সে গ্রাম থেকে শহরে এসেছে, হোটেলে টেবিল মোছার কাজ পেয়েছে, হোটেলেই রাতে থাকে, মাসিক বেতন সাতশ’ টাকা ইত্যাদি। সবশুনে হেলপার শহরটির নাম জিজ্ঞেস করলে হামিদ তালগোল পাকিয়ে ফেলল। একবার মনে হলো রংপুর শহর, পরক্ষণে ভাবল বগুড়া হতে পারে, আবার মনে পড়ল ঢাকা শহরের নাম। তাই সে শহরের নাম না বলে বলল- ‘যে শহরের চৌরাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধু’র বড় একটা ছবি বানাইছে, সেই শহর।’ হেলপার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে ড্রাইভারের শরনাপন্ন হলো।
সব শুনে ড্রাইভার রাতে গ্যারেজেই থাকার ব্যবস্থা করলো হামিদের। পরদিন থেকে গ্যারেজের পাশে ‘পাভেল ব্যাটারি সার্ভিসিং’-এ শুরু হলো হামিদের ভিন্ন কর্মজীবন। গাড়ি থেকে ব্যাটারি ডাউন করা, এসিড পাল্টানো, পানি ভরানো, ব্যাটারি চার্জ করা, ব্যাটারি আপলোড করার কাজ হয় এখানে। তবে হোটেলের চাইতে তার ভালোই লাগলো। হোটেলে এঁটো টেবিল মুছতে মুছতে হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে সাদা ঘা হয়েছিল। টেবিল মোছার পর খাবারের আঁশটে গন্ধে ঘিনঘিন লাগতো। এখানে তার কাজ নির্ধারিত হলো- দোকানঘরের মেঝে ঝাড়– দেওয়া, ওস্তাদের পানের খিলি কিনে আনা, এটা-ওটা এগিয়ে দেওয়া আর ওস্তাদের কাজ দেখে দেখে কাজ শেখা। বিনিময়ে কোনো বেতন-ভাতা পাবে না, পাবে তিন বেলা খাবার আর দোকানঘরে ঘুমানোর সুযোগ।
এটাকেই ভক্তি ভরে মেনে নিল হামিদ। মনে মনে স্থির করলো, এখানে তো আর বেশি দিন থাকছে না সে। পরিচিত কারো দেখা পেলেই গ্রামে ফিরে যাবে। মা ও আর ছোটো বোন পারুলকে এখন মিস করছে খুব। মা কাজে বের হয়ে গেলে পারুল কার সাথে খেলে। হামিদ না থাকায় খেলার সময় সবাই ‘পারুল’কে মারে না তো? অথবা বেঈমানী করে পারুলকে হারিয়ে দেয় নাতো? না, সে এখানে থাকবেই না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে গ্রামে ফিরবেই। গ্রামের পরিচিত কারো দেখা না পেলে অন্তত আবার যেদিন ‘সাদা-গেঞ্জি’ পরে আর লাল-নিশান মাথায় বেঁধে জনসভায় যাবে, সেদিন সে হোটেলের সেকেন্দার, রব্বানী, কালু, জাহাঙ্গীর, কেকারুদের খুজে বের করবেই। তারপর হোটেলে ফিরে গিয়ে হোটেল মালিককে বলবে তাকে গ্রামে ফিরিয়ে দিতে আসতে।
মাস তিনেকের মধ্যে হামিদের ভেসে ওঠা বুকের পাজরের হাড্ডির ওপর চর্বি জগাতে শুরু করছে। এখনো হাড্ডিগুলো দেখা যায় কিন্তু গণনা করার মতো আর স্পষ্ট নয়। গায়ের রঙটাও আরো কালো হয়েছে কিন্তু ত্বকে তৈলাক্ত ভাব চকচক করছে। একরকম কেটেই যাচ্ছিল হামিদের। অল্পদিন পরে আবার বিধি বাম হলো। একটা ব্যাটারি তুলে এনে রাখতে গিয়ে হাত থেকে ছিটকে পড়ল। ব্যাটারি ফেটে এসিডে ভিজে গেল হামিদের মুখ, গলা, বুক আর পেট। দোকান মালিক তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে কোনমতো বারান্দায় ফেলে রেখে কেটে পড়ল।
তখন হামিদ অজ্ঞান। ঘণ্টা দুয়েক পড়ে থাকলো জরুরি বিভাগের বারান্দায়। কে তাকে ভর্তি করাবে? কিভাবে? গোলাপী বাসফোর ঝাড়– দিতে এসে বেওয়ারিশ লাশ ভেবে দূর থেকে মেঝে ঝাড় দিল। তারপর বারান্দার বসে পান চিবাচ্ছে। হঠাৎ দেখল লাশটি নড়াচড়া করছে। ছুটে গেল কাছে। নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখল নিঃশ্বাস চলছে। ছুটে গেল ভর্তি কাউন্টারে। বলল- ‘রে বাবু, মাটিতে লাশ লয়, বাচ্চাটি তো বাঁচিয়া আছে। হা, বাঁচিয়া আছে। বেবস্তা করো। ভরতি করিয়া লও’।
গোলাপী বাসফোর ছুটো ছুটি করে হাসপাতালে ভর্তি নিশ্চিত করলো। চিকিৎসা শুরু হলে ঔষধ-পথ্যের দরকার হলো। গোলাপী সাধ্যমতো চেষ্টা করলো কিন্তু কুলাতে পারলো না। গোলাপী’র পীড়াপীড়িতে হাসপাতাল সমাজসেবা এগিয়ে এলো। তিনমাস পর হাসপাতাল থেকে নাম কাটা হলো হামিদের। দু’চোখের পাতা ছাড়া সারা মুখের চামড়া ঝলশে বিকৃত হয়েছে। শ্বাসনালী পুড়ে কী সমস্যার কারণে হামিদ আর কথাও বলতে পারে না। পেটের চামড়ায় টান পড়ায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। এখন হামিদ যাবে কোথায়? গোলাপী জলকর সুইপার কলোনীতেই নিয়ে এলো হামিদকে। গোলাপীর স্বামী ‘রংলাল’ স্পিরিট খেয়ে কেবল ফিরেছে। গোলাপীর সাথে বিকৃত হামিদকে দেখে রেগে বলল- ‘মাগী হামি তুমার স্বামী আছে। তুমহার নাঙ কেনে লাগিবে, হা?’
রংলালের নেশা কেটে গেলে গোলাপী সব খুলে বলল। রংলালের মায়া হলো। হামিদের কাছে গিলে বলল- ‘বাবু, হামারা মেথর আছি। তুমহার সাকিন কাহা?’
হামিদ কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু গো গো শব্দ ছাড়া কিছুই বের হলো না। রংলাল বলল- ‘‘মেথর পট্টীতেই তোমার সাকিন হবে বাবু। হা। কোনো ছমোৎসা হবেক লয়। হা হবেক লয়।’’ হামিদ কিছু বলতে পারল না। হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকলো। দু’গাল বেয়ে মাটিতে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ল চোখের পানি। রংলালও কান্না সংবরণ করতে পারল না দু হাতে মুছে নিল নিজের চোখ।
অনেক দিন পর একদিন হামিদ দেখলো সুইপার কলোনীতেও সবার জন্য সাদা-গেঞ্জি আর লাল-নিশান এসেছে। পরদিন কেউ কাজে যাবে না। সাদা-গেঞ্জি আর লাল-নিশান পরে অনেকে যাবে মিছিল ও জনসভায়। গোলাপী হামিদকেও পড়িয়েছে সাদা-গেঞ্জি। দুই হাতে আর মাথায় বেধে দিয়েছে লাল-নিশান। রাস্তার পাশে হামিদকে চটের উপর বসিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে গোলাপী ও রংলাল দুজনেই। যারা মিছিল ও জনসভায় যাবে তারা একে একে জড়ো হচ্ছে। মিস্ত্রিপাড়া থেকে একটা মিছিল আসছে। সুইপার কলোনীর বাসিন্দারা এই মিছিলের সাথে যুক্ত হয়ে জনসভায় যাবে।
মিছিল যতই কাছে আসছে ততই কাঁদছে হামিদ। আজ তার মিছিলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। ইচ্ছে ছিল জনসভা থেকে খুঁজে বের করবে হোটেলের ছেলেদের। তারপর ফিরে যাবে মায়ের কাছে। ছোট বোন পারুলের কাছে। মিছিলে যখন স্লোগান উঠছে ‘দুনিয়ার মজদুর’ কিংবা ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’ কিংবা ‘এই লড়াইয়ে জিতবে কারা’- সব স্লোগানের প্রতিস্লোগান দিচ্ছে হামিদ, যথাসাধ্য জোরে। কিন্তু গো গো শব্দ ছাড়া কিছুই বের হচ্ছে না। হামিদ চিৎকার করে গো গো করছে আর দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি।
চটে বসে কাঁদতে দেখে মিস্ত্রিপাড়া থেকে আসা মিছিলের কে যেন একটা পাঁচ টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়েছে হামিদের দিকে। তখনই ক্ষেপে উঠেছে রংলাল বাসফার- ‘রাম রাম রাম, হামারা ফকির লয় রে বাবু। হামারা কাজ করিয়া খাই। হামারা সুইপার আছি হা। তু লিয়ে যা গা টাকা’। রাগে রক্তবর্ণ চোখ কোঠর থেকে যেনো বেড়িয়ে আসছে রংলালের। হাতে ও মাথায় বাঁধানো কাস্তে-হাতুরি ও মুষ্টিবদ্ধ হাত খচিত লাল নিশান ঝাঁকিয়ে রংলাল আবারো বলল ‘হামারা ফকির লয় গা হা...’।